বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ || ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১১ মে ২০২২

মৃত সাগরের মৃত্যু কি আসন্ন?

মৃত সাগরের মৃত্যু কি আসন্ন?

‘ডেড সি’ নাম শুনলেই গা কেমন ছমছম করে ওঠে! মনে হয়, মৃত লোকদের এক সাগর, যেখানে ভাসছে লাশ! আসলে কিন্তু তেমনটি নয়। বরং ‘ডেড সি’ ভীষণ সুন্দর একটি জায়গা। ডেড সির পানি এতটাই ঘন যে ওই পানিতে কেউ চাইলে শুয়েও থাকতে পারে। শুধু তাই নয়, পানিতে শুয়ে শুয়ে বইও পড়া যায় এখানে। কিংবা ল্যাপটপ নিয়ে গিয়ে ওখানে শুয়ে শুয়ে নেট ব্রাউজিং করা যাবে। 

তবে এর নাম কেন ‘ডেড সি’ হলো?

নাম ‘ডেড সি’ হলেও এটা কিন্তু মোটেও কোনো ‘সি’ বা সাগর নয়। ‘মৃত সাগর’ নাম হলেও এটা আসলে একটা হ্রদ। তবে মিঠাপানির নয়, এর পানি ভীষণ লবণাক্ত। সাগরের লবণাক্ত পানি এখানকার তুলনায় কিছুই নয়। এখানকার পানির লবণাক্ততা সাগরের পানির তুলনায় সাড়ে আট গুণ বেশি! এত নোনতা পানিতে না বাঁচতে পারে কোনো মাছ, না বাঁচতে পারে সাগরের নিচের অন্য কোনো গাছ।

ইসরায়েল, পশ্চিমতীর ও জর্ডানের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত এই হ্রদটি। এই বিশাল হ্রদে তাই কোনো মাছই নেই। নেই পানির নিচের কোনো গাছপালাও। আর সে কারণেই এই হ্রদকে বলা হয় ‘ডেড সি’ বা ‘মৃত সাগর’।

তবে মাছ নেই বলে যে এই হ্রদে কোনো জীবন্ত প্রাণীই নেই, তা কিন্তু নয়। এই হ্রদে বাস করে নানা রকমের ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাক। হ্রদটি কিন্তু মোটেও বিষাক্ত নয়। অনেকেই ভাবে, নির্ঘাত এই হ্রদের পানি বিষাক্ত। নইলে এতে কোনো মাছ বাঁচে না কেন? আসলে এখানে কোনো প্রাণী নেই, স্রেফ পানির লবণাক্ততার কারণে, অন্য কোনো কারণে নয়।

শুধু তাই নয়, এই হ্রদ অঞ্চলটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। এখানকার আবহাওয়া অনেক রোগ সারিয়ে তোলার জন্য তো ভালোই, এই হ্রদের তীর সূর্যস্নান করার জন্যও যাকে বলে একেবারে মোক্ষম জায়গা। তাই জায়গাটি দিন দিন পর্যটকের কাছেও খুবই প্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে যারা স্বাস্থ্য ভালো করতে ঘুরতে বের হন, তাদের জন্য এটা এক টুকরো স্বর্গ। 

 

ডেড-সি। ছবি: সংগৃহীত

ডেড-সি। ছবি: সংগৃহীত

 

এই হ্রদে লবণাক্ততার পরিমাণ প্রায় ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য সাগরের জলের তুলনায় ডেড সির জলে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর প্রচুর পার্থক্য আছে। প্রাচীনকাল থেকে এই হ্রদটির জল মিশরের মমি তৈরির জন্য় ব্যবহৃত হতো। সার উৎপাদনের জন্য, পটাশসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই হ্রদ থেকে প্রাপ্ত লবণ ও খনিজ পদার্থ বিভিন্ন প্রসাধনী ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে এখনও ব্যবহার করা হয়।

এই জলে শুধু কয়েক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ছাড়া আর কোনও প্রানীর অস্তিত্ব নেই। আর এখানে মাছ না থাকার কারণে এ হ্রদের ওপর দিয়ে কখনও পাখি উড়তেও দেখা যায় না। 

অনেকে বিশ্বাস করেন, ডেড সির মাটি অনেক ধরনের রোগ নিরাময়েও সহায়ক। আর এই কারণে এ অঞ্চলটি চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাস্থল হয়ে উঠেছে। এর মূলে রয়েছে হ্রদের জলে খনিজ দ্রব্যাদির উপস্থিতি, বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য এবং উচ্চ ভূ-মণ্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতিবেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি।

উৎপত্তির পেছনে কী মহারহস্য লুকায়িত আছে?

প্রশ্ন আসতে পারে, এ সাগর উৎপত্তির পেছনে কী মহারহস্য লুকায়িত আছে? আসলে ডেড-সি হলো পৃথিবীপৃষ্ঠের সর্ববৃহৎ গর্ত, যা দেখতে অনেকটা সাগরের মতো বলেই এ জায়গাটিকে সাগর বলা হয়। কী হয়েছিল পৃথিবীর এ অংশে, কেনই বা এরকম গর্ত বা সাগর এই এলাকায় সৃষ্টি হলো, যার অনুরূপ দ্বিতীয় কোনো নজির পৃথিবীর বুকে আর কোথাও পাওয়া যায় না। এরকম অনেক প্রশ্ন বহু বছর ধরেই জ্ঞানবান মানুষ হতে শুরু করে ভূবিজ্ঞানীদেরও তাড়া করে ফিরছে।

আল-কোরআনের বর্ণনা মোতাবেক ডেড-সি (লুত সাগর) হলো একটি অভিশপ্ত জায়গা, যেখানে হাজারো মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এক মহা-অপরাধী সম্প্রদায়কে এক মুহূর্তের মধ্যে জীবন্ত সমাধিস্থ করা হয়েছিল।

উত্তরদিক থেকে জর্ডান নদী এসে এ সাগরে পতিত হয়েছে। আবার উত্তর-পূর্ব, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে কিছু পাহাড়ি নদী জর্ডানের পশ্চিম এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ডেড-সির পূর্বকূলে পতিত হয়েছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে জানা যায়, এ সাগরের পানির পৃষ্ঠদেশ থেকে ৪০ মিটার গভীর পর্যন্ত প্রতি ১ লিটার পানি থেকে ৩০০ গ্রাম লবণ পাওয়া যায় এবং ৪০ মিটার থেকে ৩০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত প্রতি ১ লিটার পানি থেকে ৩৩২ গ্রাম লবণ পাওয়া যায়। পানির এত অধিক ঘনত্বের কারণে যে কোনো মানুষ ইচ্ছে করলেই ডেড-সির পানিতে নিজেকে ডুব দিয়ে ধরে রাখতে পারবে না, অর্থাৎ ডেড-সির পানিতে মানবদেহ সব সময় ভাসে। অধিক পরিমাণে লবণাক্ততার কারণে যদি কোনো মাছ জর্ডানের পাহাড়ি এলাকার স্বাদুপানির নদী থেকে এ সাগরে প্রবেশ করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তা মারা যায় এবং ওই মৃত মাছের দেহের ওপর তৎক্ষণাৎ লবণের পুরু আস্তরণ পড়ে ঢেকে যায়।

 

ডেড-সি। ছবি: সংগৃহীত

ডেড-সি। ছবি: সংগৃহীত

 

কোরআনের বিভিন্ন সুরায় বর্ণিত ডেড-সি (লুত সাগর) উৎপত্তির ঐতিহাসিক পটভূমি নিম্নরূপ। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত প্রাচীন উরনগরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজে প্রথমে ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে আরবের মরুভূমির বিভিন্ন প্রান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ কয়েক বছরকাল ঘুরে ঘুরে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার ও তার হুকুম মেনে চলার পথে মানবজাতিকে আহ্বান জানিয়েছেন।

অতঃপর তিনি তার এই দওয়াতের পয়গাম ও আদর্শ প্রচারের জন্য ট্রান্স-জর্ডানের বর্তমান ডেড-সি (লুত সাগর) এলাকাটিতে তার ভাতিজা হজরত লুত (আ.)কে প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য, প্রায় ৪৫০০ বছর আগে বর্তমান ডেড-সি এলাকাটিতে তদানীন্তন বিশ্বের আর্থিক ও প্রযুক্তিগতভাবে সর্বোন্নত অথচ নৈতিকতার দিক দিয়ে অধঃপতিত ও সর্বনিকৃষ্ট একটা জাতি বসবাস করত। পুরুষে-পুরুষে সমকামিতা, লুটপাট, রাহাজানি, ডাকাতি ইত্যাদি ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। প্রকাশ্য দরবারে, মাঠে, বিভিন্ন পার্কে দিবালোকে তারা সমকামে লিপ্ত হতো। হজরত লুত (আ.) তার এই জাতিকে বিভিন্নভাবে এহেন অপকর্ম হতে বিরত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন ।

কিন্তু কিছুতেই তিনি তাদের বোঝাতে ও বিরত রাখতে পারলেন না। বরং উল্টোভাবে তার জাতি তাকে দেশ হতে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তিনি আল্লাহর কাছে এ ব্যাপারে দোয়া করলেন এবং আল্লাহ তার দোয়া কবুল করলেন। লুত জাতিকে ধ্বংসের জন্য আল্লাহতায়ালা ফেরেশতা পাঠালেন। ফেরেশতারা লুত জাতিকে ধ্বংসের আগে প্রথমেই ফিলিস্তিনের হেবরনে বসবাসরত হজরত ইবরাহিম (আ.) বাড়িতে আসেন। ফেরেশতারা হজরত ইবরাহিম (আ.)কে তার দ্বিতীয়পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)-এর জন্মগ্রহণের সুসংবাদ শোনানোর পাশাপাশি হজরত লুত (আ.)-এর জাতির ওপর আসন্ন আল্লাহর গজবের দুঃসংবাদও শুনান। 
ফেরেশতাদের নিকট এ দুঃসংবাদ শুনে হজরত ইবরাহিম (আ.) লুত জাতিকে ক্ষমা করার জন্য আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করলেন। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালা লুত জাতির ধ্বংসের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। সন্ধ্যার দিকে ফেরেশতারা ফিলিস্তিনের হেবরন থেকে বের হয়ে লুত জাতির বসতিস্থল সাদুম ও গোমরা নগরীদ্বয়ের দিকে অগ্রসর হন।

যেহেতু নগরীদ্বয়ের লোকেরা সমকামিতার পঙ্কিলে নিমজ্জিত ছিল তাই তিনজন ফেরেশতা, ১. হজরত জিবরাঈল (আ.), ২. হজরত ইসরাফিল (আ.) এবং ৩. হযরত মিকাঈল (আ.) কৌশলস্বরূপ সুদর্শন ছেলে মানুষের রূপ ধারণ করে ওই এলাকায় আসেন। সুদর্শন ছেলে মানুষরূপী ফেরেশতারা সন্ধ্যার পর রাতের অন্ধকারে হজরত লুত (আ.)-এর বাড়িতে পৌঁছার পরপরই হজরত লুত (আ.)-এর স্ত্রী যে কোনোভাবেই হোক বিষয়টি জানার পর সে এলাকার যুবকদের মধ্যে গোপনে তথ্যটি ছড়িয়ে দেয়।

 

ডেড-সি। ছবি: সংগৃহীত

ডেড-সি। ছবি: সংগৃহীত

 

সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শত সহস্র যুবকদল মেহমানদের সঙ্গে সমকামিতায় লিপ্ত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে হজরত লুত (আ.)-এর বাড়িতে প্রবেশ করে। মেহমানদের ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে হজরত লুত (আ.) বারবার হীন অপকর্মের উদ্দেশে আসা যুবকদেরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চরিত্রহীন যুবকদল কোনোভাবেই এই নবীর কথায় কর্ণপাত করল না।

এ রকম অসহায় পরিবেশে হজরত লুত (আ.) আল্লাহতায়ালার দরবারে এর একটা সমাধানের জন্য দোয়া করলেন। একপর্যায়ে হজরত লুত (আ.)-এর কাছে ফেরেশতারা তাদের পরিচয় দিয়ে বলেন, রাত কিছুটা থাকতে অর্থাৎ ভোর হওয়ার আগেই হজরত লুত (আ.) যেন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এ এলাকা ছেড়ে চলে যান এবং কেউ যেন পেছন দিকে ফিরে না তাকায়।

তবে শর্ত ছিল যে, হজরত লুত (আ.)-এর পরিবারের মধ্যে হতে তার স্ত্রী সঙ্গে যেতে পারবে না, কারণ মহিলাটি তার জাতির সঙ্গে ধ্বংস হবে বলে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত ছিল। ভোর রাতে হজরত লুত (আ.) তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ভূমিকম্প শুরু হয়। ভূগর্ভ হতে পরিপক্ব মাটির প্রস্তর (ভূ-তাত্ত্বিক ভাষায়, অতি উত্যপ্ত লাভা) অবিশ্রান্তভাবে দুশ্চরিত্র জনতার ওপর বর্ষণ করা হয় এবং জমিনকে উল্টিয়ে তাদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এ সময়ে এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়েছিল। সাদুম, গোমরা ও আশপাশের অন্যান্য পাপিষ্ঠ নগরীর জমিনকে ভূ-গর্ভে মিশিয়ে দেওয়া হয়। যা বর্তমানে ডেড-সি বেসিন বা মৃত সাগর অথবা লুত সাগর নামে পরিচিতি পেয়েছে।

ডেড-সি থেকে মানবজাতির শিক্ষা

কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, লুত জাতির ঘরবাড়ি ও বস্তি-জনপদ আকাশে তুলে উল্টিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং তাদের নিচে ফেলে চাপা দেয়া হয়েছিল। ডেড-সির মতো একটি দৃশ্যমান নিদর্শনকে সামনে রেখে পরবর্তী মানবজাতিকে এ শিক্ষা নেয়ার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, সমকামিতার মতো অতি জঘন্য আপরাধ যদি কোনো জাতি করে তাহলে লুত জাতির মতো পরিণতি তাদেরও হবে। 

 

ডেড-সি। ছবি: সংগৃহীত

ডেড-সি। ছবি: সংগৃহীত

 

ভূবিজ্ঞানের গবেষণা মতে উৎপত্তি

ভূবিজ্ঞানের বর্তমান গবেষণা হতে এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, প্রায় ৪৫০০ বছর পূর্বে ডেড-সির উৎপত্তির সঙ্গে তীব্র ভূমিকম্পের সম্পর্ক ছিল। যদিও অতি প্রাচীনকালের এ ভূমিকম্পের তীব্রতা রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি, তবে ডেড-সি এলাকাটি যে একটি তীব্র ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। বর্তমানে গবেষণার সাহায্যে জানা গেছে যে, ডেড-সি এলাকাটিতে খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিভিন্ন মাত্রার অনেকগুলো ভূমিকম্প হয়েছে। অর্থাৎ ডেড-সি একটি প্রচণ্ড ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা।

‘মৃত সাগর’-এর মৃত্যু আসন্ন?

বিশ্বের সবচেয়ে নীচু জলাধার ডেড সি ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। জর্ডান নদী থেকে পানীয় জল আহরণ করছে ইসরায়েল ও জর্ডান। এর প্রভাব পড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার নীচের ডেড সি-তে। প্রতি বছর গড়ে এক মিটারের মতো নেমে যাচ্ছে ডেড সি।

জাগ্রত জয়পুরহাট

সর্বশেষ

জনপ্রিয়