শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১২:২০, ৩০ মে ২০২৩

নিজ পাঁয়ে দাঁড়াতে না পারা জিতুই এখন দেড় হাজার পরিবারের খুঁটি

নিজ পাঁয়ে দাঁড়াতে না পারা জিতুই এখন দেড় হাজার পরিবারের খুঁটি

ভূমিহীন দিনমজুর বাবার ঘরে যখন ফুটফুটে জিতু রায়ের জন্ম হয়, তখন পরিবারে আনন্দের সীমা ছিল না। তবে সেই আনন্দ মলিন হতে বেশি দিন সময় লাগেনি। চার বছর বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে জিতুর পা অকেজো হয়ে যায়। এরপর থেকে নানা সময়ে প্রতিবেশী, স্বজনদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে দিয়ে বড় হতে হয় জিতুকে। কেউ কেউ জিতুকে ভিক্ষাবৃত্তি করার কথাও বলেছিল। তবে সেসব কথায় কান না দিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আজ সফল উদ্যোক্তা তিনি।

জিতু নিজ পাঁয়ে দাঁড়াতে না পারলেও আজ দেড় হাজার পরিবারের দাঁড়িয়ে থাকার খুঁটি হয়েছেন। তার গড়া রকমারিশিশুঘর.কম ও এসএমজে ফ্যাশনে পোশাক তৈরি করে সংসারে বাড়তি আয়ের যোগান দিচ্ছেন ১০টি এলাকার প্রায় দেড় হাজার নারী। এখান থেকে এসব নারী মাসে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন।

dhakapost

১৯৮৮ সালে মহেন্দ্র রায় ও মঞ্জু রানী দম্পতির ঘরে জন্ম জিতু রায়ের। রংপুর নগরীর ঠিকাদারপাড়া এলাকায় তাদের বসবাস । দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে সবার বড় জিতু। দরিদ্র দিনমজুর বাবার এক সময় কিছু না থাকলেও এখন জিতুর পরিশ্রমের বদৌলতে বদলে গেছে কষ্টের দিনগুলো। দুঃখ ও যন্ত্রণাময় দিন শেষে জিতু রায়ের পরিবারে ফিরেছে সোনালী সুখ। বাবা, মা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গড়েছেন সুখের সংসার। এখন জিতুর আছে পাকা বাড়ি, প্রাইভেটকার, বাইকসহ কোটি টাকার সম্পদ।

সম্প্রতি রংপুর নগরীর তাজহাট ডিমলা এলাকায় নিজের গড়া রকমারিশিশুঘর.কম ও এসএমজে ফ্যাশন অফিসে কথা হয় জিতুর সঙ্গে। কারখানা ঘুরিয়ে জিতু রায় শোনান তার জীবনের গল্প। জন্মের চার বছর পর পোলিও আক্রান্ত হলে হাঁটা চলা বন্ধ হয়ে যায় জিতুর। দিনমজুর বাবা সারাদিন মাঠে পুড়ে আয় করতেন মাত্র ৩০ টাকা। এ টাকায় তখন দু-বেলার খাবার জুটতো না। তাই চিকিৎসা করাতে পারেনি। কেনা হয়নি একটি হুইল চেয়ারও।

জিতু রায়ের লেখাপড়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছা শক্তি দেখে বাবা তাকে ঘাঁড়ে করে বিদ্যালয়ে নিয়ে গেছেন। এভাবে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও পরে অভাব আর চলাচল করতে না পারায় জিতু রায়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তখন ২০০৫ সাল। পরিবারের দৈন্যদশা দেখে জিতু নেমে পড়েন ভাঙারি ব্যবসায়। বেশ কিছু দিন ব্যবসা করলে সেখানেও বাঁধা হয়ে দাড়ায় পাঁ, চলতে না পারা। এরপর মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখতে যোগ দেন।

hakapost

বাবার পিঠে চড়ে কাজ শিখতে গেলেও তিনতলা ভবনে লিফট না থাকায় সেখানেও টিকতে পারেন না জিতু। এ অবস্থায় জিতু রায় ফ্রিল্যান্সার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিং শিখতে হলে লাগবে কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ। দরিদ্র বাবার তা কেনার সমার্থ্য ছিল না। তবু দমে যাননি জিতু রায়। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে শেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কম্পিউটার শেখা তো দূরের কথা প্রতিবন্ধী বলে অনেকেই তাকে দেখে কম্পিউটার বন্ধ করে দিতেন। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কেউ কেউ তাকে ফিরিয়েও দিয়েছেন।

জিতু রায় বলেন, ২০০৯ সালে তার কম্পিউটার শেখার আগ্রহ দেখে স্কুল বন্ধু তৌফিক নিজের কম্পিউটার দিয়ে দেয় আমাকে। আরেক বন্ধু দেন ইন্টারনেট সংযোগ। শুরু হয় আমার ইউটিউব ও গুগল দেখে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শেখা। দিন রাত মত্ত হয়ে থেকেছি কম্পিউটার নিয়ে। টানা দুই বছর কাজ শিখি।

এরপর পুরোদমে লেগে পড়ি অনলাইন মার্কেটগুলোতে কাজের জন্য আবেদনে। কাজও পাই। প্রথম কাজে আয় করি ৩০০ ডলার। আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ২০১১ সালের শেষে আমার আয় দেখে মা বিক্রি করে দেন বিয়ের সময় পাওয়া স্বর্ণের রিং। সেই টাকা ও বাবার কিছু জমানো টাকা দিয়ে কেনা হয় নতুন কম্পিউটার। এরপর পুরোদমে ফ্রিল্যান্সিংয়ে লেগে পড়ি। ধীরে ধীরে আমার সঙ্গে এলাকার তরুণদের যুক্ত করতে শুরু করি।

dhakapost

জিতু জানান, ২০১১ সাল পর্যন্ত ৪০ জন তার অধীনে ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ করেছেন। তাদের সর্বোচ্চ বেতন ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের টাকায় জিতু রায় কিনেছেন প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল। নিজস্ব জমি কিনে করেছেন শিশুদের পোশাক তৈরির কারখানা, গড়েছেন পাকা বাড়ি। জিতু রায় ২০২১ সালে শুরু করেন রকমারিশিশুঘর.কম ও এসএমজে.কম ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে নিজের কারখানার তৈরি পোশাক বিক্রি করছেন। এসব পোশাক তৈরি করছেন আশেপাশের ১০টি এলাকার দেড় হাজারেরও অধিক নারী।

নগরীর মোল্লাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায় উঠানে দল বেধে সুই-সুতো দিয়ে কাপড়ে নকশা তোলার কাজ করছেন একদল নারী। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এগুলো জিতুর রকমারিশিশুঘর.কম ও এসএমজে.কমের জন্য নকশী কাথা তৈরি করছেন তারা।

সেই দলের টিম লিডার মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা মুক্তি বেগম বেগম জানান, একেকটি নকশা কাজ প্রকারভেদে ৮ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত হয়। সংসারের কাজের পাশপাশি একজন দিনে দেড় থেকে দুইশত টাকার কাজ করেন। সুই-সুতা, কাপড় সবই জিতু দাদার। আমরা শুধু নকশা করি। এখানে আমার অধীনে রয়েছে ২০০ নারী।

এছাড়া মাহিগঞ্জ, মীরগঞ্জ, তাজহাট, রঘুবাজার মদিখানা, মোল্লাপাড়া, ডিমলা, ফতেপুর, মাহিগঞ্জ থানাপাড়া, নুরপুরসহ ১০টি এলাকায় দেড় হাজারের বেশি নারী কাজ করেন বলেন জানান মুক্তি।

মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা নুসরাত জাহান বলেন, জিতু প্রতিবন্ধী হইলে কি হইবে। হামরা ওর কারখানাত কাম করোছি। ফ্রি সময় কাপড়োত নকশা তুলি কামাই করোছি। জিতু দাদার দোয়ায় এ্যালা হামরা সুকোতে আছি।

dhakapost

সেখানে নকশার কাজ করা আরেক নারী ফরিদা বেগম বলেন, জিতুর জন্যে এ্যালা মোর সংসারোত কষ্ট নাই। আগোত স্বামীর কামাই দিয়া সংসার চলছিল না। সংসারোত ঝগড়া নাগি আছিল। কিন্তু জিতু দাদার নকশা তোলার কাজ করি মাসে ৫ হাজার টাকা কামাই করোং। স্বামীর কামাই, মোর কামাই দিয়া এ্যালা তিন বেলা ভালোই চলছে।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া জিতু রায় বলেন, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মানুষ আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারি করেছে। এমনও বলেছে আমাকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া কিছুই হবে না। খুব কষ্ট হতো। সেই কষ্টগুলোই আজ আমাকে সফলতা এনে দিয়েছে। আশেপাশের অসহায় দেড় হাজার নারীদের কর্মসংস্থান করেছি। এখন স্ত্রী-সন্তান, ভাই, বাবা-মাকে নিয়ে সুখে আছে। সুযোগ পেলে আরও বড় কিছু করব।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের রংপুরের উপ-পরিচালক আবদুল মতিন বলেন, প্রতিবন্ধকতা জিতু রায়কে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম তাকে সফলতা এনে দিয়েছে। মানুষ চেষ্টা করলে যেকোনো পর্যায়ে থেকে যে সফলতা আনা যায় জিতু তারই প্রমাণ। অন্যদের কাছে জিতু দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সমাজসেবা অধিদপ্তর সব সময় জিতুর পাশে থাকবে। 

জাগ্রত জয়পুরহাট

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ