• সোমবার ২৯ মে ২০২৩ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ১৪ ১৪৩০

  • || ০৭ জ্বিলকদ ১৪৪৪

জাগ্রত জয়পুরহাট

বরেন্দ্র ভূমিতে দার্জিলিং কমলা চাষে সাইদুলের বাজিমাত

জাগ্রত জয়পুরহাট

প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর ২০২২  

সারি সারি কমলার গাছ। থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচা সবুজ ও হলুদ রঙের কমলা। রসালো কমলার ভারে প্রতিটি গাছ নুয়ে পড়ছে। কোনো কোনো গাছে বাঁশের লাঠির সাহায্যে ঢোকা দিয়ে রাখা হয়েছে। বাতাসে পাকা কমলার সুমিষ্ট গন্ধ পুরো বাগান ছড়িয়ে পড়েছে।

এমনি এক কমলার বাগানের দেখা মিলবে নওগাঁর সীমান্তবর্তী উপজেলা ধামইরহাটের আগ্রাদিগুন ইউনিয়নের হয়রতপুর গ্রামের পাশে। বাগানের মালিক সাইদুল ইসলাম পরীক্ষামূলকভাবে দার্জিলিং জাতের এই কমলা চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। প্রথমবারেই এই জাতের কমলা চাষ করে বাজিমাত করেছেন তিনি। চোখ জুড়ানো হলুদ কমলার সৌন্দর্যের সমারোহ দেখতে এসে অনেকেউ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এই কমলা চাষে। আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে এসব কমলা বাজারজাত করে লাভবান হওয়ার আশা করছেন তিনি। সাইদুল ইসলাম নওগাঁর সীমান্তবর্তী উপজেলা ধামইরহাটের আগ্রাদিগুন ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা।

সাইদুল ইসলাম ২০১২ সালে নওগাঁ সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর তিনি চাকরির পিছনে না ছুটে নিজে কিছু করার চিন্তা করেন। এই ভাবনা থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে আগ্রাদিগুন ইউনিয়নের হয়রতপুর গ্রামের পাশে প্রথমে তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে মিশ্র ফল বাগান গড়ে তোলেন। সেখানে তিনি দার্জিলিং জাতের কমলার চারা কিনে এনে এক বিঘা জমিতে রোপণ করেন। দীর্ঘ দুই বছরের পরিচর্যার পর এ বছর প্রতিটি গাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে কমলা এসেছে। এছাড়াও সেই বাগানে রোপণ করেন বারি-১ মাল্টা, বারি-৩ বারোমাসি জাতের মাল্টা, বরই, পেয়েরা, কাটিমন, আমরুপালি, বারি-৪ জাতের আমের চারা। ইতিমধ্যে মাল্টা, বরই ও পেয়ারা থেকেও ফলন পেয়েছেন তিনি। তার মিশ্র ফলের বাগানে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে ৮-১০ জন কৃষকের। বর্তমানে তার মিশ্র ফল বাগানের আয়তন ১৮ বিঘা।

এ বিষয়ে কথা হয় সাইদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ঢাকা মেইলের এই প্রতিবেদককে জানান, মাস্টার্স শেষ করে চাকরির পিছনে না ছুটে বা অন্যের অধিনে না থেকে নিজে কিছু করার ভাবনা থেকেই মিশ্র ফল বাগান তৈরির চিন্তা করেন। প্রথমে তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে মাল্টা, বরই পেয়ারা এবং আমের চারা রোপণ করেন। তখন মাথায় আসলো যেহেতু নওগাঁ আমের জন্য বিখ্যাত, আম ছাড়া অন্য কোনো ফসল ফালানো যায় কিনা। তখন পরীক্ষামূলক নীলফামারী থেকে দার্জিলিং জাতের কমলার চারা কিনে এনে এক বিঘা জমিতে রোপণ করেন।

এই নবীন উদ্যোক্তা বলেন, ‘মাল্টা, বরই, পেয়ারা ও আম পাশাপাশি কমলা চাষ করে সবচেয়ে ভালো হয়েছে কমলার ফলন। মাল্টা যেভাবে চাষ করা হয় সেভাবে কমলা চাষ করেছিলাম। এতে অন্যান্য ফসলের চেয়ে রোবালাই কম। প্রাকৃতিকভাবেই চাষ করা হচ্ছে। রোপণের পর এই প্রথম কমলার গাছে কমলা ধরেছে। প্রথমবারেই ফলন খুব ভালো হয়েছে। বর্তমানে ১৩৪টি কমলার গাছ আছে। প্রতিটি গাছ থেকে সর্বনিম্ন ২০ কেজি সর্বচ্চো ৫০ কেজি করে কমলা পাওয়া যাবে। আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে এসব কমলা বাজারজাত করবো। বাজারে কমলার দামও ভালো আছে। প্রথমবারেই দুই থেকে তিন লাখ টাকার কমলা বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি। এছাড়াও এই বাগান থেকে আরও ৬ লাখ টাকার মত তিনি মাল্টা বিক্রি করেছি।’

সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে অনেকে ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। এলাকার আগে কেউ কল্পনা করে নাই এখানে কমলা চাষ হবে। এখন অনেকেই আমার এই কমলার বাগান দেখতে এসে কমলা চাষে আগ্রহ হচ্ছেন। এবং চারা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কমলার ফলন ভালো হওয়ায় আরও বড় পরিসরে করার চিন্তাভাবনাও করছি। নিজেরায় চারা তৈরি করছি এবং যারা চারা নিতে চেয়েছেন তাদেরকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলেছি।’

কমলার বাগান দেখতে এসেছেন স্থানীয় রাকিবুল হোসেন। এসময় তিনি বলেন,  ‘সাইদুল ভাইয়ের বাগানে কমলা চাষের বিষয়টি বেশ কিছুদিন থেকে শুনছিলাম। মূলত দেখার জন্য এসেছি। বাগানে বিভিন্ন রকম ফলের গাছ দেখলাম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে কমলা। এত বেশি পরিমাণ ধরে আছে, দেখতে খুবই ভালো লাগছে। আমাদের এলাকায় এত সুন্দর কমলা হবে, কল্পনার বাইরে। এই ধরনের কমলার চাষ করতে পারলে লাভবান হওয়া যাবে।’

মাকসুদুল হাসান নামে আরেকজন বলেন, ‘সাইদুল ভাইয়ের মিশ্র ফল বাগান দেখতে এসেছি। এখানে এসে মাল্টা, কমলা পেয়ারা, আম ও বরইসহ অনেকগুলো ফলের গাছ দেখলাম। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে কমলা। এই এলাকায় কমলার এত ফলন হবে জানা ছিল না। এর আগে কখনো দেখা হয়নি। এখানে এসে নিজেও কমলা চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ হলাম। কৃষি বিভাগ থেকে সহযোগিতা করলে আমিও এই ধরনের কমলার চাষ করবো।’

ধামইরহাট উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারিত ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় ফল বাগান প্রদর্শনীর তিন বিঘা জমি সাইদুল ইসলামকে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে মাল্টা ও কমলা চাষে উপরে তা বৃদ্ধি করা হয়। এই অঞ্চল উচ্চ বরেন্দ্র-ভূমি শ্রেণির মধ্যে পড়েছে। এই জমি সমতল জমির চেয়ে উঁচু। বর্তমানে এই জমিগুলো কমলা চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো। কমলা চাষের জন্য যে ধরনের মাটি বৈশিষ্ট্য থাকার দরকার এই অঞ্চলে রয়েছে। তার বাগানের কমলা গাছের বয়স ২ বছর। এবারই প্রথম ফলন এসেছে। আশা করছি আগামী বছর এই ফলন অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।

কৃষি কর্মকর্তা আরও জানান, কৃষি বিভাগ সব সময় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে। কেউ এ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে চাইলে কৃষি বিভাগ তাদেরকে স্বাগত জানায়। সেসব প্রশিক্ষণে ভূমি শ্রেণি অনুযায়ী কোন ফসল কোন জমিতে ভালো হবে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যেসব উদ্যোক্তা ও বেকার যুবকরা কৃষিতে আসতে চায়, তাদের নিজ নিজ উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে, সে কি ফসল করতে চায় সেটার ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করলে আগামীতে কৃষি বিপ্লব ঘটবে।

জাগ্রত জয়পুরহাট
জাগ্রত জয়পুরহাট