ক্ষেতলালে পিছিয়ে পড়া অসচ্ছল নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

বসুন্ধরা গ্রুপের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জয়পুরহাটের অবহেলিত ও অনগ্রসর জনপদ ক্ষেতলাল উপজেলার পিছিয়ে পড়া অসচ্ছল নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ চলছে। বসুন্ধরা শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আওতায় উপজেলা চত্বরের একটি সংগীত বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন অসচ্ছল পরিবারের নারীরা।
ক্ষেতলাল উপজেলা শাখার বন্ধুরা নিরলস পরিশ্রম করে স্বনির্ভর হওয়ার অদম্য ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন অসচ্ছল নারীদের প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তিন মাসের এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে।নারীদের ইচ্ছা এই সেলাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তোলা। অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পরিবারের অসচ্ছলতা দূর করে সংসারে নিজের অবস্থান মজবুত করতে তাঁরা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়ার জন্য তাঁরা কৃতজ্ঞ বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি।
ক্ষেতলাল উপজেলা মূলত কৃষিনির্ভর এলাকা।এখানকার নারীরা বেশ পিছিয়ে আছেন। অভিভাবকরাও নারীদের পড়ালেখায় উদাসীন। তাঁদের ধ্যান-ধারণা, নারীদের কাজই হলো রান্নায় মনোনিবেশ করা আর বিয়ের পর ফরমাশ খাটা। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি বদ্ধমূল ধারণা।এ জন্য এ অঞ্চলে বাল্যবিবাহের প্রবণতাও অনেক বেশি। নিয়তি মনে করে অভিভাবকদের এমন সেকেলে ধারণার প্রতিবাদও করার সাহস নেই অসচ্ছল পরিবারের অবহেলিত নারীদের। সম্প্রতি নারীদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ এই অন্ধকার জগৎ থেকে তাঁদের আলোর মুখ দেখাচ্ছে, যার মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের এই উদ্যোগও একটি দৃষ্টান্ত। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া নারীদের একজন প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম কালাই উপজেলার মাধাইনগরের সুমি খাতুন।
তিনি জানান, অভাব-অনটনের কারণে অনেক আগে মা-বাবা তাঁকে বিয়ে দিয়েছেন।তখন তিনি সংসারের অর্থই বুঝতেন না। কিন্তু মা-বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। স্বামী মুজাহিদের সঙ্গে সংসার করছেন প্রায় পাঁচ বছর ধরে। স্বামীর নিজের কোনো জমিজমা নেই। পুকুরে মাছ চাষ আর অন্যের জমি আদি-বর্গা নিয়ে সংসার চলে তাঁদের। সুমি গৃহিণী। স্বামীর কাজে সহযোগিতা করা ছাড়া তাঁর কোনো কাজ নেই। সুমির ইচ্ছা, সংসারের পাশাপাশি নিজে কিছু করার। এর মধ্যেই সুযোগ আসে বিনা মূল্যে বসুন্ধরা শুভসংঘ সেলাই প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার। অসচ্ছল পরিবারে পড়ালেখার সুযোগ না পেলেও অক্ষরজ্ঞান রপ্ত করেছেন ছোটবেলায়। সপ্তাহে তিন দিন ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ক্ষেতলালে সেলাই প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। এর মধ্যেই শিখে নিয়েছেন মেয়েদের জামা, কামিজ, ম্যাক্সিসহ ছেলেদের পোশাক তৈরির কাজ। তাঁদের গ্রামে কোনো দরজি নেই। তাঁর আশা, প্রশিক্ষণ শেষে বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে যে সেলাই মেশিন পাবেন, সেটি দিয়ে গ্রামের নারী-পুরুষের পোশাক সেলাই করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাবেন। বসুন্ধরা গ্রুপকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা জানান সুমি খাতুন। দুই হাত তুলে দোয়া করেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যার ও তাঁর পরিবারের জন্য।
সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নের কথা শোনালেন দিনাজপুর জেলার বিরামপুরের এতিম পরিবারের মেয়ে স্বপ্না আখতার। মা-বাবা কেউ নেই। বিয়ে হয়েছে ক্ষেতলাল পৌর এলাকার দীঘিপাড়া মহল্লায়। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়। স্বামী মামুনুর রশিদ দোকান কর্মচারী। স্বামীর আয় দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন চলে তাঁদের। সংসারে আয় করার কোনো সুযোগ নেই স্বপ্নার। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করা ছাড়া তাঁর কোনো উপায় ছিল না। এতেও বাদ সাধেন স্বামী। অভাব-অনটনের সংসারে অনেকটা বন্দি জীবন কাটে স্বপ্নার। বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় সেলাই প্রশিক্ষণের সুযোগ পাওয়ায় স্বপ্না এখন স্বপ্ন দেখছেন স্বাবলম্বী হওয়ার। আড়াই মাসে অনেক কাজ রপ্ত করেছেন। মেয়েদের পোশাক তৈরির সব কৌশলই তিনি শিখেছেন। ছেলেদের শার্ট, ফতোয়াও তৈরি করতে পারবেন জানিয়ে স্বপ্না বলেন, ‘যেদিন সেলাই প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি, সেদিনই আয়োজকদের প্রাণ ভরে দোয়া করেছি। তাঁদের সহযোগিতা না পেলে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নটুকুও দেখতে পারতাম না। আমার মতো অবহেলিত ও অসচ্ছল পরিবারের নারীদের স্বাবলম্বী করার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তাঁরা। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যারসহ এ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য অনেক দোয়া করি। আল্লাহ তাঁদের দীর্ঘজীবী করুন।’
পৌর সদরের রসালপাড়া এলাকার অসচ্ছল পরিবারের গৃহিণী সামছুন্নাহার বলেন, ‘দরিদ্রতাকে নির্মমভাবে মোকাবেলা করে আমরা বেঁচে আছি। মেয়ের পড়ালেখার খরচ দিতে পারি না। দুবেলা দুমুঠো ভাতও ঠিকমতো জোটাতে পারি না। বসুন্ধরা গ্রুপের সেলাই প্রশিক্ষণ এখন আমার একমাত্র ভরসাস্থল। প্রশিক্ষণ শেষ করে একটি মেশিন পেলে সেলাই ফোঁড়ার কাজ করে সংসারে দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটাতে পারব।’ প্রতিবন্ধী স্বামীর সংসারে সহযোগিতা করার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন গৃহবধূ বর্ষা আক্তার। স্বামী মো. সোলায়মান ঘরে বসে প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালান। আগের মতো আর শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না। সংসার চলে নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে। বর্ষার ইচ্ছা ভালো দরজি হওয়ার। বর্ষা বলেন, ‘স্বামী প্রতিবন্ধী হওয়ায় শারীরিক পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে পারেন না। প্রাইভেট পড়ানোর টাকায় এখন সংসার চলে না। শুনেছি, প্রশিক্ষণ শেষে বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে সেলাই মেশিন দেওয়া হবে। সেলাই মেশিন পেলে আমি মাসে ভালো আয় করতে পারব। বিভিন্ন টেইলারিংয়ের দোকানে বর্তমানে পোশাক তৈরির মজুরি বেশ চড়া। গ্রামের মানুষ স্বল্প খরচে পোশাক তৈরি করে। সেই সুযোগ আমি কাজে লাগাতে পারব। বাড়ির খেয়ে পোশাক তৈরি থেকে মাসে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। বসুন্ধরা গ্রুপের এমন মহতী উদ্যোগ আমাদের মতো বেকার নারীদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মহোদয়কে।’
হরিজন সম্প্রদায়ের মেয়ে আঁঁখি বাঁশফোঁড়। বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়। মা চুমকি বাঁশফোঁড় মেয়েকে কষ্ট করে পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর অর্থাভাবে ছন্দঃপতন ঘটে আঁঁখির পড়ালেখায়। সেই থেকে মায়ের সংসারে বোঝা হয়ে আছেন। কাজ করার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও হরিজন সম্প্রদায়ে জন্ম নেওয়া আঁঁখির ভাগ্য বদল হয় না। বসুন্ধরা গ্রুপের সেলাই প্রশিক্ষণে সুযোগ পেয়ে তাঁর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। আঁঁখি এখন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আঁঁখি বলেন, ‘নিজেরা স্বাবলম্বী হতে না পারলে সংসারে নারীদের অসম্মানিত থাকতে হয়। আমার মাকে খুব কাছ থেকে আমি পরনির্ভরশীল হয়ে সংসার করতে দেখেছি। আমি সেটি চাই না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। প্রশিক্ষণ শেষে আমাকে সেলাই মেশিন দেওয়া হবে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে। এটিই হবে আমার আগামী দিনে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।’
কালাই উপজেলার রোয়াইর গ্রামের মোরশেদা বেগম ও সুমি আক্তার, কাঁচাকুল গ্রামের হেলেনা আক্তার, কলিংগা গ্রামের সাবলী আক্তার, ধাপ কালাই গ্রামের নাদিরা বেগমসহ অন্যরাও খুশি সেলাই প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে। তাঁদের প্রত্যেকের অভিব্যক্তি একই। স্বাবলম্বী হওয়ার এমন সুযোগ লুফে নিয়ে তাঁরা এখন স্বপ্ন দেখছেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। প্রশিক্ষণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এরপর বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে বিনা মূল্যে সেলাই মেশিন দেওয়া হবে। এই মেশিন তাঁদের জীবন পাল্টে দেবে- এমন প্রত্যাশা সবার।
ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোস্তাকিম মণ্ডল বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে অসচ্ছল নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য যেভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে, তা বিরল ঘটনা। এটি মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিনা মূল্যে শুধু প্রশিক্ষণ নয়, তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হবে সেলাই মেশিন। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মহোদয়ের এমন মানবিকতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা নিজেদের কর্মজীবী হিসেবে গড়ে তুলবেন। আমি বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তাঁর পরিবারের সবার সুখী, সমৃদ্ধ জীবন ও মঙ্গল কামনা করছি।’