শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৩:৩৩, ৮ নভেম্বর ২০১৮

ডিম পাখি পাড়ে, কিন্তু পাখিও তো ডিম ফুটেই বের হয়

ডিম পাখি পাড়ে, কিন্তু পাখিও তো ডিম ফুটেই বের হয়

এই তর্কটার কথা সবাই জানেন। ডিম পাখি পাড়ে, কিন্তু পাখিও তো ডিম ফুটেই বেরোয়। তাহলে কে আগে কে পরে? এই তর্কের এখনো মীমাংসা হয়নি বললে কথাটা একটু অতিরঞ্জন হবে। মীমাংসা হয়েছে, তবে সাধারণ পাঠক সেটা সবাই জানেন না বলে মনে হয়। অবশ্য তর্কটাই যে আছে তাও অনেকে জানেন না। কিন্তু লেখাপড়া করা মানুষের মধ্যে এ নিয়ে হয়তো কখনো প্রশ্ন ওঠে, যাদের মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান নেই তারা সহজে এর উত্তর পান না। মনোবিজ্ঞান বা মনোভাষাবিজ্ঞানে অনভিজ্ঞ পাঠকের জন্য এই লেখা।

চিন্তা আর ভাষার ব্যাপারে এই একটা সমস্যা ছিল। হয়তো এখন মনে হতে পারে, আরে! এটা একটা সমস্যা নাকি? ওটা তো ছিল একটা আপাত-সমস্যা, তবু প্রশ্নটা অনেকদিন ধরে আমাদের ঝামেলায় ফেলেছে। বিশেষ করে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে – মানুষ আগে চিন্তা করে তারপর কথায় তা প্রকাশ করে, নাকি ভাষা ছাড়া মানুষ চিন্তা করতেই পারে না, ভাষাই চিন্তার একমাত্র বাহন? অর্থাৎ প্রথম একদল অনেক ক্ষেত্রেই দুয়ের সম্ভাব্য বিচ্ছেদ কল্পনা করে, বলে যে ভাষা ছাড়াও চিন্তা করা যায়। তারা অবশ্য এমন চরম কথা বলেন না যে, ভাষায় চিন্তা করা যায় না। ভাষার মধ্যস্থতায় চিন্তা অবশ্যই করা যায়, ভাষায় চিন্তা প্রকাশিত হয়। মানুষের যদি ভাষা না অর্জিত হতো তাহলে মানুষ এত বিচিত্র চিন্তা করতেই পারত না, প্রকাশ করতে তো পারতই না; কিন্তু ভাষা ছাড়াও চিন্তা করা সম্ভব। আরেক দল বলে বা বলত যে, দূর! ভাষা ছাড়া চিন্তা সম্ভবই নয়। প্রথম দলে আছেন চমস্কির এককালের এমআইটির ছাত্র জেরি ফোডোর আর দ্বিতীয় দলে আছেন ভিগোৎস্কি নামক রুশ মনোবিজ্ঞানী, আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী ব্লুমফিল্ড – এবং আরো কেউ কেউ।

ফোডোরের যুক্তি, আচ্ছা, পশুপাখির তো ভাষা নেই, কিন্তু তারা কি চিন্তা করে না? কিংবা যে-শিশু ভাষা শেখেনি, তার কি কোনো চিন্তাপ্রক্রিয়া নেই? ‘সামনে গাছপালাগুলো নড়ছে, কে জানে ওখানে আমাদের বিপদ লুকিয়ে আছে কি না -’ হরিণ বা জেব্রার দল কি এরকম ভাবে না? এখনো নানা জায়গায় যে বর্ষার পরে হনুমানের দল চলে আসে খাবার-ফল ইত্যাদি লুটপাটের বাসনা নিয়ে – তাদের কি কোনো চিন্তা থাকে না যে, ‘এই সময়ে ফলটল পাকবে, চলো দলবেঁধে উদ্যোগ নিই?’ শিশু কি কখনো তার মা সম্বন্ধে ভাবে না যে, ‘এই মহিলার ওপর আমি খাদ্য বা অন্যান্য ব্যবস্থার জন্যে বেশ নির্ভর করতে পারি, তাই এই মহিলা কাছে থাকলে আমার ভালো লাগবে।’ নিশ্চয়ই পশুপাখিরা এবং শিশুরা এমন ভাবে। এমনকি ফোডোর আরো একটা অতি অকাট্য যুক্তি দিতেই পারতেন; জীবজগতের বিবর্তনের যুক্তি, সেটা হলো, ‘আরে মানুষ তো বহুদিন কথা বলতেই শেখেনি, তা যখন তাদের ভাষা ছিল না তখন কি তারা চিন্তা করত না? নিশ্চয়ই করত।’ ঠিক কথা! মানুষ এসেছে পৃথিবীতে তা প্রায় আশি-নব্বই হাজার বছর হবে; আর তার ভাষা তৈরি হয়েছে বড়জোর চল্লিশ হাজার বছর আগে। তাহলে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর কি সে আদৌ চিন্তা করেনি? এসব যুক্তি কেউ অস্বীকার করার কথা ভাবে না।

আমরা প্রথমেই এই আধুনিক সিদ্ধান্তটি, হয়তো শেষ সিদ্ধান্তটি দিয়ে শুরু করলাম যে, চিন্তা আগে, ভাষা পরে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে অনেক বিতর্কের পথ পেরোতে হয়েছে। এ-প্রবন্ধে সেই বিতর্কের সূত্রগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব। এবং শেষকালে এই ইঙ্গিতও দেওয়ার চেষ্টা করব যে, জানি না সে-চেষ্টার আদৌ দরকার আছে কি না – ভাষার সাহায্যে চিন্তার মধ্যে যে-ঐশ্বর্য সঞ্চারিত হয়েছে, তা ভাষা ছাড়া সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ ভাষা ছাড়া চিন্তা সম্ভব হলেও ভাষার সঙ্গে যুক্ত হয়ে চিন্তার যে বিস্তার, বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি ঘটেছে তা ভাষার আগে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না।

জাগ্রত জয়পুরহাট

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ