শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১২:৪৭, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

হতাশা মুমিন জীবনের সাথে বেমানান

হতাশা মুমিন জীবনের সাথে বেমানান

আশা ছেড়ে নিজের ব্যর্থতাকে কবুল করে নেয়াই হতাশা। সঠিক পন্থায় চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, আমাকে দিয়ে হবে নাÑ এমন চিন্তা করে হাল ছেড়ে দেয়া মানে নিজেকে হতাশার কাছে সমর্পণ করা। একজন জ্ঞানবান লোক কখনোই এমনটি করতে পারেন না। তিনি অবশ্যই আশা নিয়ে পথ চলতে থাকেন। কোনো কাজ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে নিজের পরিকল্পনায় কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে; তা বের করে নিজেকে সংশোধন করেন। প্রকৃত যোদ্ধা নিজেকে বারবার সংশোধন করেন কিন্তু ভীরু ও অজ্ঞ ব্যক্তি ইতিবাচক চেষ্টা না করে নিজেকে হতাশার জালে বন্দী করে নেয়।
কুরআনে হতাশ হওয়াকে গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা বলা হয়েছে। সূরা হিজরের ৫৬ নং আয়াতে বলা হয়, ‘পথভ্রষ্ট লোকেরাই তো তাদের রবের রহমত থেকে নিরাশ হয়।’ এই আয়াতটি মূলত ইবরাহিম আ: ও ফেরেশতাদের কথোপকথনের অংশ। যখন আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা একটি সন্তান দেয়ার সুসংবাদ নিয়ে হজরত ইবরাহিম আ:-এর কাছে এলেন তখন এই কথোপকথন হয়। ফেরেশতাদের সাথে আলাপচারিতায় ইবরাহিম আ:-কে যখন সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হলো তখন ইবরাহিম আ: বললেন, ‘তোমরা কি বার্ধক্যবস্থায় আমাকে সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছ? একটু ভেবে দেখো তো এ কোন ধরনের সুসংবাদ তোমরা আমাকে দিচ্ছ?’
তখন ফেরেশতারা জবাব দিলেন, ‘আমরা তোমাকে সত্য সুসংবাদ দিচ্ছি, তুমি নিরাশ হয়ো না।’ ফেরেশতাদের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ইবরাহিম আ: নিরাশা বা হতাশা বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করলেন। সেই কথাটিই সূরা হিজরের ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। সুতরাং হতাশ হওয়া মানে নিজেকে পথভ্রষ্টতার দিকে ঠেলে দেয়া।
আপনি কঠিন কোনো সমস্যায় আছেন? নিজে বা পরিবারের কেউ দীর্ঘদিন রোগে আক্রান্ত? হতাশ হবেন না। হজরত আইয়ুব আ:-এর ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করুন। তিনি চরম রোগে আক্রান্ত হয়েও আল্লাহ শোকর আদায় করতে ভোলেননি। কেউ আপনাকে ঠকিয়েছে? নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হন। আপনি ভুল মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। ভুল সংশোধন করে নতুন করে পথ চলা শুরু করুন।
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় বা কোনো কাজ করার সময় ; এ বিষয়ে ইসলাম কী বলেছে সেটা চিন্তা করি না। এখানেই আমরা ভুলটা করে বসি। ইসলাম তো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সুতরাং জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনে আপনি সর্ব প্রথম ইসলামকে প্রশ্ন করুন। নিজে উত্তর না পেলে প্রসিদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য আলেমের কাছে গিয়ে জানার চেষ্টা করুন। আপনি সঠিক পথ খোঁজার চেষ্টা করলে অবশ্যই আপনার পালনকর্তা সহযোগিতা করবেন। মূলত ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ না করার কারণেই আমরা বারবার ব্যর্থ হই। কাজটি যদি ইসলাম সমর্থিত এবং সঠিক পন্থায় হতো তাহলে হয়তো আপনার বর্তমান অশান্তি বা অস্থিরাতার সূচনাই হতো না।
সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এবং সঠিক পন্থায় কাজ করেও যখন আমরা ব্যর্থ হই তখনো হতাশ হওয়া যাবে না। বরং বুঝতে হবে আমি কোনো পরীক্ষার মধ্যে আছি। সবকিছু যদি সঠিক পন্থায় হয়ে থাকে তাহলে এই ব্যর্থতা আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থতা হলেও এর পেছনে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে, নিশ্চয় আমাকে নিয়ে আমার পালনকর্তা মহান আল্লাহর কোনো পরিকল্পনা রয়েছে। হয়তো আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তা বুঝতে পারছি না। এরকম পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করা আবশ্যক এবং হতাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
হতাশা কাটাতে হজরত ইউসুফ আ:-এর জীবন পরিক্রমার দিকে খেয়াল করুন। যখন হজরত ইয়াকুব আ:-এর ছেলে হজরত ইউসুফ আ:কে তার অন্য ভাইয়েরা মরুভূমির একটি কুয়ার মধ্যে ফেলে দিলেন তখন কিন্তু ইয়াকুব আ: হতাশ হননি। এমনকি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও ইউসুফ আ: কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বেঁচে আছেন না-কি মারা গেছেন? কিছু না জেনেও ধৈর্য ধারণ করেন বাবা হজরত ইয়াকুব আ:। এ দিকে আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল ইউসুফ আ:কে মিসরের বাদশাহ বানানো। আল্লাহ পরিকল্পনা মাফিক ইউসুফ আ:কে বণিকদের মাধ্যমে কুয়া থেকে উদ্ধার করে অনেক ঘটনার পর রাজপরিবারে নিয়ে যুক্ত করে দিলেন। ইউসুফ আ: রাজপরিবারে বেড়ে ওঠায় রাজ্য পরিচালনার অনেক বিষয় তিনি ছোট থেকে রপ্ত করতে পারলেন। এভাবে অনেক ঘটনার পর তিনি হলেন মিসরের বাদশাহ। সবই ছিল আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ।
জীবনের কোনো দুর্ঘটনা বা সফলতাই আল্লাহর পরিকল্পনার বাইরে নয়। বরং আল্লাহর পরিকল্পনার মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খাই। বিপদে ধৈর্য ধারণ কঠিন কাজ। তাই আল্লাহ ঘোষণা করলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, সবর এবং সালাতের মাধ্যমে সাহায্য গ্রহণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন।’ অর্থাৎ বিপদে আল্লাহকে স্মরণ রাখতে হবে; যদিও এটি কাঠিন মুহূর্ত। তবে আল্লাহ এই কঠিন মুহূর্তে বান্দাকে ছেড়ে যাননি বরং সালাত ও ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে আল্লাহ সাহায্য পাওয়ার পথ বান্দার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমরা ভুল করি। আমরা ভুলে যাই। এটাই মানুষের প্রকৃতি। কিন্তু ভুল করে বা ভুলে গিয়ে ভুল বোঝার পরে আমাদের সেই ভুল ভাঙতে হবে। এটাই প্রকৃত ঈমানদারের রূপ।
ভুলের ওপর অটল থাকাটাই বোকামি এবং সর্বনাশের কারণ। ভুল ভাঙতে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দেরি হয়ে যায়। তত দিনে জীবনের অনেক পথ আমরা নষ্ট পথে অতিক্রম করে ফেলি। তখন চিন্তা আশে, আমি তো অনেক ভুল করেছি। ভুল বুঝতে আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন কি আমার ফিরে আসার পথ আছে? এমন বান্দাহদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! বলে দাও, হে আমার বান্দাহরা, যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা যুমার : ৫৩)
এই আতায়ের মধ্যে শুধু মুসলমানদের সঠিক পথে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা নয় বরং অমুসলিমদেরও রবের পথে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা রয়েছে। ভুল বুঝে অনুতপ্ত হয়ে খালেস নিয়তে তাওবার মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া পাওয়া যাবে। তাফসিরের কিতাবে অত্র আয়াতে ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এখানে সব মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে। শুধু ঈমানদারদের সম্বোধন করা হয়েছে এ কথা বলার কোনো উপযুক্ত প্রমাণ নেই। তা ছাড়া আল্লামা ইবনে কাসির লিখেছেন, গোটা মানবজাতিকে সম্বোধন করে এ কথা বলার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তায়ালা তাওবা ও অনুশোচনা ছাড়াই সব গোনাহ মাফ করে দেন। পরবর্তী আয়াতটিতে আল্লাহ নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, গোনাহ মাপের উপায় হচ্ছে আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা এবং আল্লাহর নাজিলকৃত বাণীর অনুসরণ করা। এ আয়াতটি প্রকৃতপক্ষে সেসব লোকের জন্য আশার বাণী বয়ে এনেছিল যারা জাহেলি যুগে হত্যা, ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি এবং এ ধরনের বড় বড় গোনাহর কাজে লিপ্ত ছিল আর এসব অপরাধ যে কখনো মাফ হতে পারে সে ব্যাপারে নিরাশ ছিল। তাদের বলা হয়েছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। তোমরা যা কিছুই করেছ এখনো যদি তোমাদের রবের আনুগত্যের দিকে ফিরে আসো তাহলে সবকিছু মাফ হয়ে যাবে। ইবনে আব্বাস রা:, কাতাদা রা:, মুজাহিদ র: ও ইবনে যায়েদ র: এ আয়াতের এ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। (ইবনে জারির, বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি)
সুতরাং হতাশা নয়; চলার পথে ভুল হয়ে গেলে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ হুকুমের কাছে ফিরে আসাতেই সফলতা। আল্লাহ আমাদের বোঝার তাওফিক দান করুন। আমিন। সাংবাদিক

জাগ্রত জয়পুরহাট

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ