শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ || ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৫ মার্চ ২০২৩

রোজা যেভাবে আমাদের ওপর ফরজ হলো

রোজা যেভাবে আমাদের ওপর ফরজ হলো

রোজার ইতিহাস দীর্ঘতর। পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও রোজার বিধান কার্যকর ছিল। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন- یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববতীদের দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পারো।’ (সুরা বাকারা: ১৮৩)

এই আয়াতই সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে আগেকার উম্মতকেও রোজার বিধান দেওয়া হয়েছিল। তবে, বিভিন্ন বর্ণনামতে এর সংখ্যা ও নিয়ম হুবহু আমাদের মতো ছিল না। কারো রোজার সংখ্যা ছিল ৩০টি, আবার কারো ৪০টি ইত্যাদি। কোনো উম্মতের ক্ষেত্রে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কারো সঙ্গে কথা না বলাও রোজার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পবিত্র কোরআনে মরিয়ম (আ.)-এর ভাষ্যে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে কাউকে যদি তুমি দেখ তখন বলবে, আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে রোজার (মৌনতা অবলম্বনের মাধ্যমে) মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করব না।’ (সুরা মরিয়ম: ২৬)

হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে মহানবী (স.)-এর আগের নবী হজরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত রোজার বিধান ছিল। এমনকি ইসলাম আগমনের পূর্বে আরব সমাজেও রোজার প্রচলন ছিল। সেই রোজা নবীজিও রাখতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘জাহেলি যুগে কুরাইশরা আশুরার রোজা পালন করত এবং আল্লাহর রাসুল (স.)-ও এই রোজা পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখনো এই রোজা পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন আশুরার রোজা ছেড়ে দেওয়া হলো। যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না।’ (সহিহ বুখারি: ২০০২)

হিজরত পরবর্তী সময়ে আশুরার রোজাই মুসলমানের জন্য ওয়াজিব ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবী (স.) যখন মদিনায় আসেন তখন দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তাদের রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, এই দিনেই আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের ওপর বিজয় দিয়েছিলেন। তাই আমরা ওই দিনের সম্মানে রোজা পালন করি। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা (আ.)- এর বেশি নিকটবর্তী। এরপর তিনি সাওম পালনের নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহ বুখারি: ৩৯৪৩)

এছাড়াও মুসলিমরা প্রত্যেক মাসে তিন দিন রোজা পালন করত বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। তবে বেশির ভাগ ফকিহ ও মুহাদ্দিসের মতে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ওয়াজিব ছিল, যা পরবর্তী সময়ে নফলে পরিণত হয়। আর আইয়ামে বিজ বা প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখার বিধান সব সময় মোস্তাহাব ছিল। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমার বন্ধু (স.) আমাকে তিনটি কাজের অসিয়ত করেছেন। মৃত্যু পর্যন্ত আমি তা ত্যাগ করব না। তা হলো—প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা, চাশতের নামাজ আদায় করা এবং বিতর আদায় করে শোয়া।’ (সহিহ বুখারি: ১১৭৮)

রমজানের রোজা
দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানের রোজা ফরজ হয়। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) মোট ৯ বছর রমজানের রোজা রেখেছেন। কেননা তা দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে ফরজ হয়। আর নবী (স.) একাদশ হিজরির রবিউল আউয়ালে ইন্তেকাল করেন।’ (আল-মাজমুআ: ৬/২৫০)

রমজানের রোজা যখন প্রথম ফরজ হয়, তখন মুমিনদের রোজা রাখা ও ফিদিয়া দেওয়ার ইচ্ছাধিকার দেওয়া হয়। অর্থাৎ যে চাইবে রোজা রাখবে আর যে চাইবে রোজার পরিবর্তে মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। এ বিধান সুস্থ-অসুস্থ, সবল-দুর্বল সবার জন্যই ছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘(তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে) রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। এটা যাদের সাতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদয়া—একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর রোজা পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা জানতে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৪)

এরপর কোনো অবকাশ ছাড়াই রোজা ফরজ হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস। এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)

অবকাশ ছাড়া রোজা ফরজ হওয়ার কালে সময়সীমাও পরিবর্তন হয়ে যায়। তাফসিরে ইবনে কাসিরে উল্লেখ করা হয়েছে, রমজানের রোজা যখন ফরজ হয়, তখন রাতের বেলা ঘুমের আগ পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী-সম্ভোগের অনুমতি ছিল। এশার নামাজ বা ঘুমের পর পানাহার ও স্ত্রী-সম্ভোগ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আল্লাহ সময় সংক্ষিপ্ত করে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার সময় নির্ধারণ করেন।

এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘রোজার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ জানেন যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করেছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাদের সঙ্গে সংগত হও এবং আল্লাহ যা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তা কামনা করো। আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ রাতের কৃষ্ণরেখা থেকে ঊষার শুভ্র রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রতিভাত না হয়।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭)

এই হলো উম্মতে মুহাম্মদির ওপর চূড়ান্তভাবে রোজা ফরজ হওয়ার ইতিহাস। এর কোনো বিধি কেয়ামত পর্যন্ত পরিবর্তন বা পরিমার্জন হবে না। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুন্নাহনির্দেশিত পন্থায় রমজানের রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

জাগ্রত জয়পুরহাট

সর্বশেষ

জনপ্রিয়