মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ || ৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:৩২, ২০ মার্চ ২০২৩

রমজানে যেসব গুনাহ ভুলেও করবেন না

রমজানে যেসব গুনাহ ভুলেও করবেন না

মাহে রমজান মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এ মাস আখেরাতের পাথেয় গোছানোর মাস। বরকত ও নাজাতের মাস। এই মাসে বর্ষিত হয় রহমতের বারিধারা। গুনাহ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য পবিত্র রমজান একটি চমৎকার সময়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় রমজানের রোজা পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে, সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে সালাত (নামাজ) আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (সহিহ বুখারি: ১৮৮৭)

পবিত্র রমজানে ক্ষমালাভের মাধ্যমে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করার সুযোগ লাভ হয়। যে ব্যক্তি রমজান পেয়েও তার পাপগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না, মহানবী (স.) তাকে ধিক্কার দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যার কাছে রমজান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি।’ (জামেউল উসুল: ১৪১০) আরেক বর্ণনায় মহানবী (স.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলোধূসরিত হোক, যে রমজান পেল এবং তার গুনাহ মাফ করার আগেই তা বিদায় নিল।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৫৪৫)

বিভিন্ন গুনাহে জড়িত থাকার কারণে তারা কল্যাণপ্রাপ্ত হয় না। যে গুনাহগুলো রোজার মান কমিয়ে দেয়। অনেকাংশে রোজার কোনো সওয়াব লাভ হয় না, সেরকম কিছু গুনাহ নিচে তুলে ধরা হলো।

১) মিথ্যা 
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও তদনুযায়ী আমল করা বর্জন করেনি, তার এই পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি: ১৮০৪)

২) গিবত 
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, রোজা হলো (জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার) ঢাল, যে পর্যন্ত না তাকে বিদীর্ণ করা হয়। জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ, কিভাবে রোজা বিদীর্ণ হয়ে যায়? নবী করিম (স.) বললেন, মিথ্যা বলার দ্বারা অথবা গিবত করার দ্বারা। (আলমুজামুল আওসাত, তাবারানি: ৭৮১০; নাসায়ি: ২২৩৫) মুজাহিদ (রহ.) বলেন, দুটি অভ্যাস এমন রয়েছে, এ দুটি থেকে যে বেঁচে থাকবে তার রোজা নিরাপদ থাকবে—গিবত ও মিথ্যা। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৮৯৮০; ইমদাদুল ফাত্তাহ, পৃষ্ঠা-৬৭৪; মাজমাউল আনহুর: ১/৩৬০)

৩) হারাম খাওয়া
সেহেরি ও ইফতারে ব্যবহৃত সবকিছুই নিখুঁত, পবিত্র ও হালাল অর্থে উপার্জিত হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমাদের আমি যেসব পবিত্র রিজিক দিয়েছি, তা থেকে আহার করো। পাশাপাশি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করো, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করে  থাকো।’ (সুরা বাকারা: ১৭২) তিনি আরো ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের আমি যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি, তা থেকে আহার করো।’ (সুরা বাকারা: ১৭২)

৪) টিভিতে বাহারি অনুষ্ঠান দেখে সময় পার করা
যেসব কাজ সাধারণত গুনাহ হিসেবে গণ্য, সেসব কাজ রমজানে আরো বেশি মারাত্মক। যেমন টিভিতে বাহারি অনুষ্ঠান দেখা, গান শোনা, মেয়েদের ছবি দেখা। এসব গুনাহে রোজার অন্তর্নিহিত শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। তবে এসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় না। রোজা মাকরুহ হয়ে যায়। দিনে বা রাতে কখনোই কাজগুলো করা বৈধ নয়। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ সাওম পালন করলে সে যেন পাপাচারে লিপ্ত না হয় এবং মূর্খের মতো আচরণ না করে।’ (আবু দাউদ: ২৩৬৩)

৫) মদপান ও গান-বাজনা করা-শোনা
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমণীদের গান বাজতে থাকবে।’ আল্লাহ তাআলা তাদের জমিনে ধসিয়ে দেবেন এবং তাদের কিছু লোককে বানর ও শূকরে রূপান্তরিত করবেন। (ইবনে মাজাহ: ৪০২০)

৬) প্রতারণা করা 
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা-প্রতারণা ও গুনাহের কাজ ত্যাগ করে না, আল্লাহ তাআলার কাছে তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো মূল্য নেই।’ (আবু দাউদ: ৩৩৬২)

৭) মানুষের দোষ-ত্রুটি খোঁজা
রোজা রেখে অন্যের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানোও অনুচিত। মানুষের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা একে অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ কোরো না এবং পরস্পর গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা ঘৃণাই করে থাকো। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা সহুজুরাত: ১২)

৮) রাত জেগে গল্পগুজব, শপিং ও আড্ডা দেওয়া
আমরা অনেকেই রমজানের রাতে না ঘুমিয়ে গল্প করে রাত কাটাতে পছন্দ করি। কেউ আবার শপিং করে, রেস্টুরেন্টে আড্ডা দিয়ে, অনলাইনে সাহরি পর্যন্ত সময় পার করি। যা একেবারেই ঠিক নয়। রমজান মাস ইবাদতের মাস। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে...।’ (মুসনাদে আহমদ: ৬৬২৬) তাই এ মাসের প্রতিটি সময় বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, দোয়া, তাওবা ও নফল নামাজের মাধ্যমে কাটানোর চেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

৯) সেলফি ও আত্মপ্রদর্শন
অনেকে রমজান মাসে সেহেরি ও ইফতারের সময় সেলফি ও আত্মপ্রদর্শন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এসব মূলত অনর্থক কাজ। ইসলাম কোনো অনর্থক কাজই সমর্থন করে না। উপরন্তু আত্মপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত করলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ প্রতিটি ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য শর্ত হলো, তা শুধু আল্লাহর জন্যই হতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি লোকদেখানো ইবাদত করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার লোকদেখানো উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন।’ (বুখারি: ৬৪৯৯)

১০) অশ্লীলতার সহায়ক কাজ
পবিত্র রমজানে অশ্লীলতা ও নোংরামির সহায়ক কাজগুলো থেকেও বিরত থাকা উচিত। যেমন অতিরিক্ত স্মার্টফোন আসক্তি, গায়রে মাহরামের সঙ্গে কথা বলা বা সাক্ষাৎ করা ইত্যাদি। এসব কাজ মূলত মানুষকে অজান্তেই খারাপ পথের দিকে নিয়ে যায়। স্মার্টফোনে হারাম কিছু না দেখলেও এর দ্বারা প্রচুর সময় নষ্ট হয়।

আর যদি রমজানে স্মার্টফোনে রাতভর হারাম ভিডিও দেখা হয়, তাহলে তার পরিণাম হবে আরো ভয়াবহ। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, চোখের জিনা হলো হারাম দৃষ্টিপাত। কর্ণদ্বয়ের জিনা হলো ‘গায়রে মাহরামের যৌন উদ্দীপক’ কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শোনা। জিহ্বার জিনা হলো, ‘গায়রে মাহরামের সঙ্গে সুড়সুড়িমূলক’ কথোপকথন। হাতের জিনা হলো, ‘গায়রে মাহরামকে’ ধরা বা স্পর্শকরণ। পায়ের জিনা হলো, ‘খারাপ উদ্দেশ্যে’ চলা। অন্তর চায় ও কামনা করে আর লজ্জাস্থান তাকে বাস্তবে রূপ দেয় ‘যদি জিনা করে’ এবং মিথ্যা পরিণত করে ‘যদি অন্তরের চাওয়া অনুপাতে জিনা না করে’। (মুসলিম: ২৬৫৭)

 ১১) অশালীন কথা বলা
রমজানে রোজা রেখে অশালীন কথা বলা, গালি দেওয়া নিষেধ। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে তখন সে যেন অশালীন কথাবার্তা না বলে ও হৈচৈ না করে।’ (বুখারি: ১৯০৪)

১২) অপচয় ও অপব্যয়
পবিত্র মাহে রমজানে একদম ব্যয়কুণ্ঠতা অবলম্বন করা যেমন উচিত নয়, তেমনি অপব্যয় করাও উচিত নয়। রমজানে ব্যয় ও খাবারেও সংযম পালন করা জরুরি। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে ‘(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা অপব্যয়ও করে না, আবার কৃপণতাও করে না। তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।’ (সুরা ফুরকান: ৬৭)

রমজানে আত্মীয়-স্বজন ও গরিব প্রতিবেশীদের খোঁজখবর রাখা অপরিহার্য। শুধু নিজ পরিবার নিয়ে দামি দামি ইফতার করলেই রোজার পরিপূর্ণ বরকত অর্জন সম্ভব নয়।

১৩) অশালীন চলাফেরা 
মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য পর্দার বিধানের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য। রমজানে এ বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। এই বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই হৃদয়-মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। পর্দার এই সুফল স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এই বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’ (সুরা আহজাব: ৫৩)

১৪) নামাজ না পড়া
অনেকে রোজা রাখেন, কিন্তু নামাজ পড়েন না। অথচ নামাজও আল্লাহর ফরজ বিধান এবং ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ পড়া জরুরি। আর রমজান মাসে ফরজ নামাজের বাইরে তারাবি ও তাহাজ্জুদ নামাজের বিধান দেওয়া হয়েছে। সুতরাং রমজান মাসে নামাজ না পড়া রমজানের মহিমা ক্ষুণ্ন করে। তাই নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ পড়া জরুরি। 

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মুসলমানদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফরজ।’ (সুরা নিসা: ১০৩)

১৫) মাতা-পিতার সঙ্গে অসদাচরণ
শুধু রমজান নয়, কখনো কোনো বিষয়ে মাতা-পিতার সঙ্গে অসদাচরণ করা যাবে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করো না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে কোনো একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তাহলে তাদের ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং ধমক দিয়ো না এবং তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ২৩)

রমজান সম্পর্কিত হাদিসে এসেছে, ‘যে তার মাতা-পিতাকে পেল, অথচ জান্নাত কামাই করে নিতে পারল না, সে ধ্বংস হোক।’ অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুলে (স.)-কে জিজ্ঞাসা করেন, সন্তানের ওপর মাতা-পিতার হক কী? জবাবে বিশ্বনবী (স.) বলেন, ‘তাঁরা তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।’ (ইবনে মাজাহ: ৩৬৬২)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র রমজানে উল্লেখিত গুনাহ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করু। রমজানের পবিত্রতা রক্ষা ও যথাযথ হক আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।

জাগ্রত জয়পুরহাট

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ

শিরোনাম