মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ || ৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:০৫, ১৫ মে ২০২১

আত্মবিচারই শুদ্ধির রাজপথ

আত্মবিচারই শুদ্ধির রাজপথ

মুহাসাবা আরবি শব্দ। বাংলায় এটিকে আমরা আত্মপর্যালোচনা বলতে পারি। ইসলামে আত্মপর্যালোচনার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোরআন-সুন্নাহে এ বিষয়ে বিশেষ তাগিদ এসেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। এবং প্রত্যেকের উচিত আগামীর জন্য সে কী করেছে তা খতিয়ে দেখা...।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ১৮)

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ  করেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৯) একজন মুমিন দুনিয়াকে মনে করে তার কর্মক্ষেত্র আর আখিরাতকে বিবেচনা করে ফলাফল লাভের স্থান হিসেবে। ফলে সে বারবার তার কৃতকর্মের হিসাব করে। উৎকৃষ্ট কর্মের ওপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। আর মন্দ কর্মের ওপর লজ্জিত হয়। নিজেকে শুধরে নিতে ও বদলে দিতে প্রত্যয়ী হয়।

মনীষীদের দৃষ্টিতে আত্মপর্যালোচনা

মুসলিম মনীষীরা মুহাসাবাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং মানুষকেও এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলতেন, (আখিরাতে) তোমাদের হিসাব নেয়ার আগে নিজেরা নিজেদের হিসাব কর। একইভাবে আমল পরিমাপের আগে নিজেরা একটু মেপে দেখ। কেননা আগামী দিনের হিসাব-নিকাশের আগে আজ নিজের হিসাব মিলিয়ে নেয়া সহজ। (ইগাসাতুল লাহফান, পৃষ্ঠা : ৯৪)

মাইমুন ইবনে মিহরান রহ. বলতেন, কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকি হতে পারে না, যতক্ষণ না সে আত্মপর্যালোচনায় কঠোর না হয়। (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, পৃষ্ঠা : ৪২৯) 

আত্মপর্যালোচনার পর্যায়

আত্মপর্যালোচনার দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় হলো- যেকোনো কাজের আগে পর্যালোচনা করা। কাজটি যদি সাধ্যাতীত হয় তাহলে সে পথে পা না বাড়ানো। আর যদি নাগালের মধ্যে থাকে তাহলে চিন্তা করবে কাজটি তার কতটুকু উপকার বয়ে আনবে? যদি সেটি অনর্থক কাজ হয়, তাহলে সেটা ত্যাগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ ও ঈমানের পরিচায়ক। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অনর্থক বিষয় ত্যাগ করা’ (তিরমিজি,  হাদিস : ২৩১৮)। অতঃপর কাজটি যদি উপকারী হয়, তখন চিন্তা করবে কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করছে কি না? যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হয় তাহলে কাজটি করবে। আর যদি ইখলাসে ঘাটতি থাকে তাহলে কাজটি ছেড়ে দেবে বা নিয়ত সংশোধন করে নেবে। দ্বিতীয় পর্যায়ের মুহাসাবা হলো কার্যসম্পাদনের পর। এই মুহাসাবার কয়েকটি ধরন রয়েছে। যেমন- মুমিন কোনো ভালো কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে মানবীয় দুর্বলতার কারণে কোনো ভুল হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই যেকোনো ভালো কাজের পর মুমিনের উচিত আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করা। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ইস্তেগফার করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে আর তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তুমি তোমার রবের প্রশংসায় তাসবিহ পড় এবং ইস্তেগফার কর। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।’ (সুরা : নাসর, আয়াত : ১-৩)

কার্যসম্পাদনের পর মুহাসাবার আরেকটি ধরন হলো- শয়তানের ধোঁকায় কোনো গুনাহ হয়ে গেলে দ্রুত তাওবা করে ফেলা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই ভুল করে। তবে সর্বোত্তম হলো সে, যে ভুলের পর তাওবা করে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৯৯) এ ছাড়া একজন মুমিন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, বার্ষিক কর্মকাণ্ডেরও হিসাব করে থাকে। অতীত জীবন শুধরে ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর করার চেষ্টা করে। ইবনু উমর (রা.) বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং ভোরে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার অবকাশে পীড়িত অবস্থার জন্য সঞ্চয় করে রেখ। আর জীবিত অবস্থায় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিও। (বুখারি, হাদিস : ৬০৫৩)

আত্মপর্যালোচনার বহু উপকারিতা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি নিচে আলোচনা করা হলো- 

নিজের অপরাধ সম্পর্কে অবগত হওয়া
একজন মানুষ সফল হতে চাইলে নিজের দোষ চিহ্নিত করে সেগুলো সংশোধন করার বিকল্প নেই।

আল্লাহর হক সম্পর্কে অবগতি
বান্দাকে আল্লাহ তাআলা অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। এই নিয়ামতের বিপরীতে বান্দার কর্তব্য হলো সর্বদা আল্লাহর অনুগত থাকা।.

আত্মশুদ্ধি
মুহাসাবার মাধ্যমে যখন একজন মুমিন স্বীয় অপরাধ সম্পর্কে অবগত হয়, তখন তার মধ্যে আত্মশুদ্ধির প্রেরণা জাগ্রত হয়। আর নিশ্চয়ই আত্মশুদ্ধি মুমিনের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যারা আত্মশুদ্ধি করে তাদের ব্যাপারে কোরআনে বলা হচ্ছে, ‘যে আত্মশুদ্ধি করে সে সফলকাম হয়।’ (সুরা : শামস, আয়াত : ৯)

আখিরাতের হিসাব সহজ হওয়া
দুনিয়ায় হিসাব-নিকাশ করলে আখিরাতের হিসাব সহজ হয়ে যায়। কেননা মুহাসাবার মাধ্যমে নিজের অপরাধ সম্পর্কে অবগত হয়ে বান্দা নিজেকে সংশোধন করে নেয়। গুনাহের জন্য তাওবা করে। নেক আমলের পাল্লা ভারী করার চেষ্টা করে। ফলে তার আখিরাতের হিসাব সহজ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে অচিরেই তার হিসাব-নিকাশ সহজ হয়ে যাবে।’ (সুরা : ইনশিকাক, আয়াত : ৭-৮)

নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়
মুহাসাবার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে অবগত হয়। ফলে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আর আল্লাহ তাআলাও তার নিয়ামত বাড়িয়ে দেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা যদি শুকরিয়া আদায় কর, আমি তোমাদের নিয়ামত বাড়িয়ে দেব।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৭)

পরিশেষে, মৃত্যু অবধারিত কিন্তু তার সময় অজানা। একটি মুহূর্তও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। তাই সবার উচিত এখন থেকেই আত্মপর্যালোচনা করা। মন্দ কাজের জন্য তাওবা করা। ভালো কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া। অনিশ্চয়তায় ভরা দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবনকে কাজে লাগিয়ে একটি সমৃদ্ধ আখিরাত বিনির্মাণ করা। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

জাগ্রত জয়পুরহাট

সর্বশেষ

জনপ্রিয়