শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:২৯, ৯ মে ২০২১

রমজানে ইতিকাফের বিধিবিধান ও ফজিলত

রমজানে ইতিকাফের বিধিবিধান ও ফজিলত

শরিয়তে ইতিকাফ বলা হয়, বিশেষ নিয়তে বিশেষ অবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করা। ইতিকাফ করা অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্য সব কিছু থেকে আলাদা করে নেয়। ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়।

আজ থাকছে রমজানে ইতিকাফের বিশেষ ফজিলতের শেষ পর্ব- 

শুধু ২৭ তারিখ কিংবা শেষ তিন দিন ইতিকাফ করলে সুন্নত আদায় হবে?
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, রমজানের ২৭ তারিখ শবেকদর। যেহেতু ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্য শবেকদরের তালাশ, তাই যারা চাকরিজীবী তারা যদি শুধু ২৭ তারিখ অথবা শেষ তিন দিন ইতিকাফ করে তবে সুন্নত আদায় হবে? শবেকদর সম্পর্কে সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও বিতর্কমুক্ত অভিমত হলো, শবেকদর শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে কারো জন্য ইবাদত করা সম্ভব না হলে ২৭তম রাতে কিছুতেই উদাসীন থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে ওই দিন মাগরিব ও এশার নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করলে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী সে-ও শবেকদরের ফজিলত পেয়ে যাবে। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি এশা ও ফজর নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে, সে যেন সারা রাত দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৫৬)

এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ বলে থাকেন, ২৭তম রজনীকে অধিক গুরুত্ব দেয়া অবৈধ কিংবা বিদাত! অথচ এর স্বপক্ষে হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামদের আমল রয়েছে। হজরত শুবা (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) শবে কদরের রাতে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি তা সম্পর্কে অবগত আছি। (আর তা হলো ২৭তম রাত) কেননা রাসূল (সা.) এ রাতে আমাদের নামাজে দাঁড়াতে আদেশ করতেন। (মুসলিম, হাদিস : ৭৬২)

অনুরূপ ধারণা পোষণ করতেন হজরত মুয়াবিয়া (রা.), হজরত ইবনে আব্বাস (রা.), হজরত হাসান (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.)। (কুরতুবি)

যেসব কারণে ইতিকাফ ভেঙে যায়
শেষ দশকের সুন্নাত ইতিকাফকারীর জন্য মানবীয়। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়, বের হলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। সুতরাং ফরজ গোসল ছাড়া গরম ও গায়ের দুর্গন্ধের কারণে গোসল করার জন্য বের হওয়া জায়েজ নেই। হ্যাঁ, যদি অতীব প্রয়োজন হয় এবং মসজিদে গোসলের সুব্যবস্থা থাকে, তাহলে মসজিদেই গোসল করবে অথবা ভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছে ফেলবে। আর ইস্তেঞ্জা করতে গিয়ে অজু পরিমাণ স্বল্প সময়ের মধ্যে সাবান ইত্যাদি ছাড়া স্বাভাবিক গোসল করতেও কোনো অসুবিধা নেই। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪৪০, ২/৪৪৫, আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫১৫)

জানাজা ও রোগীর সেবা ইত্যাদির জন্য মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। (ফাতাওয়া শামি : ২/২১৩) ইতিকাফ অবস্থায় মেসওয়াক অথবা ব্রাশ করার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যাবে না। গেলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। হ্যাঁ, অজু করার জন্য বের হলে তখন মেসওয়াকও করে নেবে। শুধু মেসওয়াক বা ব্রাশ করার জন্য বাড়তি সময় যাতে নষ্ট না হয়। (ফাতাওয়ায়ে শামি, ৩/৪৩৯) এ হিসেবে ফোনে কথা বলার জন্যও মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই।

ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত। তাই কেউ যদি অসুস্থতার দরুন অপারগ হয়ে রোজা ভাঙতে হয়, তবে ইতিকাফও ভেঙে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে শামি, ৩/৪৩১) অসুস্থতার দরুন নিরুপায় হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেও ইতিকাফ ভেঙে যাবে। তবে অপারগতার দরুন গুনাহগার হবে না। (ফাতাওয়া কাজী খান : ১/২২৩)

কোথায় ও কীভাবে ইতিকাফ করবেন
ইতিকাফ একটি মহৎ ইবাদত। এ ইবাদত প্রত্যেক মুসলমানের জন্য স্বেচ্ছায় পালনীয়। পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্বাদা কিফায়া। কেউ যদি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতে চায়, তাহলে সে যেন ২০ রমজান সূর্যাস্তের আগেই ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করবে। (বুখারি, হাদিস : ২০২৭)

এক মহল্লায় একাধিক মসজিদ থাকলে প্রতিটি মসজিদে ইতিকাফ করা উত্তম। তবে তা জরুরি নয়। বরং যেকোনো মসজিদে ইতিকাফ করলে মহল্লাবাসীর পক্ষ থেকে যথেষ্ট। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৪২, ২/৪৫, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৭/১৬৯) কোনো গ্রামের মসজিদে অন্য গ্রামের লোকের ইতিকাফের দ্বারা ওই গ্রামের সবার পক্ষ থেকে ইতিকাফের সুন্নাতে মুয়াক্বাদায়ে কেফায়া আদায় হয়ে যাবে। তবে গ্রামবাসীর জন্য উচিত, তাদের মধ্য থেকে কেউ ইতিকাফে বসা। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৭/১৭১)

ইতিকাফ স্বেচ্ছায় পালন করতে হবে। ইসলামী শরিয়তে বিনিময় দিয়ে ভাড়া করে ইবাদত পালন করার সুযোগ নেই। তাই কাউকে টাকার বিনিময়ে ইতিকাফ করা এবং করানো সম্পূর্ণ নাজায়েজ। এভাবে ইতিকাফ করানোর দ্বারা মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হতে পারবে না। (রদ্দুল মুহতার : ২/৫৯৫, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৭/১৭১)

প্রস্রাব-পায়খানাসহ মানবীয় ও শরয়ি প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। যদি মসজিদের সীমানার ভেতরে অজুর সুব্যবস্থা না থাকে, তাহলে শুধু অজুর জন্য বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫১০) ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদের আদবের খেলাফ কোনো কাজ করা বা মুসল্লি ও ফেরেশতাদের কষ্ট হয় এমন কোনো কাজ করার অনুমতি নেই। তাই নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুযায়ী মুতাকিফ ব্যক্তি বায়ু নির্গমনের জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩৬১, ইমদাদুল ফাতাওয়া : ২/১৫২)

রমজান মাসে ইতিকাফকারী মসজিদের মুয়াজ্জিন হোক বা না হোক, বিদ্যুৎ থাকুক বা না থাকুক—সর্বাবস্থায় মসজিদের বাইরে গিয়ে আজান দিতে পারবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২১২, রদ্দুল মুহতার : ২/৪৪৬) ইতিকাফকারীর জন্য জানাজা বা রোগী দেখার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ নেই। তবে ইস্তেঞ্জা বা কোনো প্রয়োজনে বের হয়ে পথিমধ্যে রোগী দেখা এবং জানাজায় শরিক হওয়া জায়েজ আছে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২১২, মাআরিফুস সুনান : ৫/৫৪০)

যে ব্যক্তি সুন্নাত ইতিকাফ শুরু করে ভেঙে ফেলেছে, সে রমজানের পর রোজাসহ এক দিন ও এক রাত ইতিকাফ করবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪৪৫) মাগরিবের পরও যদি কেউ প্রবেশ করে, তাহলে সুন্নাত ইতিকাফ হবে না, তার ইতিকাফ নফল হিসেবে গণ্য হবে। (ইমদাদুল ফাতাওয়া)
এই ইতিকাফের শেষ সময় হলো ঈদের চাঁদ ওঠার দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তাই ২৯ রমজান বা ৩০ রমজান সূর্যাস্তের আগে যদি চাঁদ দেখা যায়, তবুও সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। (ফাতাওয়া শামি : ২/১৩৭)

ইতিকাফকারীর জন্য প্রাকৃতিক ও শরিয়ত সমর্থিত প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েজ। তাই প্রস্রাব-পায়খানা, ফরজ গোসল, খাবার পৌঁছে দেয়ার লোক না থাকলে খাবার নিয়ে আসার জন্য, ইতিকাফরত মসজিদে যদি জুমার ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে জুমার নামাজ আদায় করার জন্য অন্য মসজিদে যাওয়া জায়েজ। (ফাতাওয়া শামি : ২/১৩২) প্রাকৃতিক ও শরিয়ত সমর্থিত প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয়ে যদি প্রয়োজন শেষে আধা মিনিটও দেরি করা হয়, তাহলে এতেও ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (তহতবি : ৫৮৫; হিন্দিয়া : ১/২১২)

বাথরুম যদি মসজিদের অনেক দূরে থাকে, তাহলে প্রস্রাব-পায়খানার জন্য সেখানে যাওয়াও বৈধ। (ফাতাওয়া শামি : ২/১৩২) ফরজ গোসল ছাড়া অন্য যেকোনো গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। (ফাতাওয়া শামি : ২/১৩২) এ ক্ষেত্রে বড় পাত্রের ব্যবস্থা করে মসজিদের ভেতর এমনভাবে গোসল করা যায়, যাতে গোসলের পানি মসজিদে না পড়ে কিংবা কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে নেবে।

ইতিকাফকারী একান্ত প্রয়োজনের ক্ষেত্রে স্মার্টফোন ব্যবহার করে শেয়ার বিক্রি করতে পারবে। তবে এ ধরনের কাজে বেশি সময় দেয়া যাবে না। (ফাতাওয়া শামি : ৩/৪৪০)

ইতিকাফের প্রকারভেদ
ইতিকাফ তিন প্রকার। ১. সুন্নত : শেষ দশকের ইতিকাফ। ২. নফল : যে কোনো সময় সেই ইতিকাফ করা যায়। ওয়াজিব : মানতের ইতিকাফ। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৯৮, বাহরুর রায়েক ২/৪২১, বাদায়েউস সানায়ে ২/১০৯)

ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান
ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো বাইতুল্লাহ শরিফ। বাইতুল্লাহ শরিফের পর মসজিদে নববি। এরপর বাইতুল মাকদিস বা মুকাদ্দাস। তারপর জুমা আদায় করা হয় এমন মসজিদ। এরপর মহল্লার যে মসজিদে নামাজির সংখ্যা বেশি হয়, সে মসজিদে ইতিকাফে সওয়াব বেশি।

নারীদের ইতিকাফ
পুরুষদের ন্যায় নারীদের জন্য ইতিকাফ সুন্নত। কিন্তু তারা ঘরে ইতিকাফ করবে। ইতিকাফের জন্য ঘরের নির্দিষ্ট নামাজঘরকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারো নামাজের জন্য নির্দিষ্ট নামাজঘর না থাকলে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানকে কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে নেয়া যেতে পারে।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তার স্ত্রীরা ইতিকাফ করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ১৮৬৮, মুসলিম, হাদিস : ২০০৬)। আয়েশা (রা.) আরো বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক রমজানে ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৪১);

ইতিকাফে যেসব কাজ করা মাকরুহ
ইতিকাফে যেকোনো অপ্রয়োজনীয় কাজই মাকরুহ। যেমন অনর্থক গল্প করা, বিনা প্রয়োজনে বেচাকেনা করা, মোবাইলে গেম খেলা, ফেসবুকে চ্যাট করা ইত্যাদি। একান্ত প্রয়োজনের ক্ষেত্রে বেচাকেনা করার অনুমতি আছে। ব্যবসায়ী মালামাল মসজিদে নিয়ে আসা মাকরুহ। যদিও একান্ত প্রয়োজনে বেচাকেনা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

ইতিকাফ অবস্থায় চুপ করে বসে থাকাও কোনো ইবাদত নয়। তাই ইবাদত মনে করে চুপ করে বসে থাকাও মাকরুহ। (আহকামে ইতিকাফ ফাজায়েল ও মাসায়েল, ৬৫)

জাগ্রত জয়পুরহাট

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ