রজনীকান্ত এবার আর পারলেন না

তাঁর সিনেমা মুক্তির দিনে তামিলনাড়ুজুড়ে হুলুস্থুল পড়ে যায়। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আর স্কুল-কলেজ পালিয়ে ছেলে-বুড়োর দল ছোটে সিনেমা হলে। বহুদিন ধরে চলা এমন রেওয়াজ আছে আগের মতোই, তবু বছর কয়েক আগেও পর্দায় যেন রজনীকান্তের সেই জাদু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে কি রজনীজাদু ফুরিয়ে গেল; এমন ফিসফাস জোরালো হওয়ার আগেই তিনি ফিরেছিলেন প্রবলভাবে। ‘জেলার’ দিয়ে সাধারণ দর্শক আর সমালোচক দুইয়েরই মন ভরিয়েছিলেন রজনীকান্ত। এবার তিনি জুটি বেঁধেছেন দক্ষিণের আরেক আলোচিত নির্মাতা লোকেশ কঙ্গরাজের সঙ্গে। তাই প্রত্যাশার পারদ চড়ে ছিল, বক্স অফিসে রজনী-লোকেশের ‘কুলি’ কত ব্যবসা করবে সেই হিসাবও করতে বসেছিলেন অনেকে। কিন্তু মুক্তির পর কি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল বহুল চর্চিত সিনেমাটি?
একনজরে
সিনেমা: ‘কুলি’
ধরন: অ্যাকশন থ্রিলার
পরিচালনা: লোকেশ কঙ্গরাজ
অভিনয়: রজনীকান্ত, আক্কিনেনি নাগার্জুনা, উপেন্দ্র, সৌবিন শাহির, সত্যরাজ, শ্রুতি হাসান ও আমির খান
স্ট্রিমিং: অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট
লোকেশ কঙ্গরাজ আর নতুন নির্মাতা নেই। আট বছরের ক্যারিয়ার, ছয়টি ছবি; তবে বৈচিত্র্য বাড়ার বদলে দিনে দিনে অতি অনুমিত হয়ে যাচ্ছেন। একসময় ‘কাইথি’-তে শেষ দিকে গ্যাটলিং গান বের করার মুহূর্তটা ছিল তামিল সিনেমার অন্যতম রোমাঞ্চকর ক্লাইম্যাক্স। কিন্তু এরপর পাঁচ ছবি আর একগাদা অস্ত্র ব্যবহারের পর লোকেশের ছন্দ এখন সহজেই আন্দাজ করা যায়। ‘লিও’-তে যখন দেখা গেল পার্থিবান/লিও পরিবারসহ পোষা হায়েনাকে খাওয়াচ্ছে, তখনই বোঝা যাচ্ছিল প্রাণীটা পরে ফিরে আসবে। কুলিতে এসে সেই সূত্র আরও স্পষ্ট।
তাই ‘লোকেশিজম’ এবার ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে। ‘লিও’ পর্যন্ত পুরোনো ’৯০-এর গান ব্যবহার করে অ্যাকশন দৃশ্যে নতুন প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা জমেছিল; কিন্তু কুলিতে এসে সেটি আর জমেনি। বরং মনে হয়েছে, বারবার নিজেকেই অনুকরণ করার অদ্ভুত চেষ্টা করছেন পরিচালক।
গল্প শুরু হয় দেবার (রজনীকান্ত) পুরোনো বন্ধু রাজশেখরের (সত্যরাজ) হত্যাকে ঘিরে। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায়, তিনি ছিলেন সদালাপী এক উদ্ভাবক। তাঁর মৃত্যুর রহস্যভেদে নেমে পড়েন দেবা, সঙ্গী হন রাজশেখরের মেয়ে প্রীতি (শ্রুতি হাসান), যিনি ছোট বোনদের দেখাশোনা করতে গিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছেন। তাঁদের অনুসন্ধান গিয়ে ঠেকে দয়াল (সৌবিন শাহির) ও তাঁর কর্তা সাইমনে (নাগার্জুনা)। দয়াল এক হিংস্র খলনায়ক, যে সন্দেহভাজন গুপ্তচরদের খুঁজে বের করতে শ্রমিকদের নির্বিচার হত্যা করছে। দেবা কি পারবেন বন্ধুদের খুনিদের শাস্তি দিতে? এই প্রশ্নের অপেক্ষা করতে করতেই সামনে আসে দেবার অতীত।
লোকেশ চেষ্টা করেছেন রজনীকান্তের মতো বড়া তারকাকে নিয়ে বাণিজ্যিক সিনেমা বানাতে; কিন্তু দুর্বল চিত্রনাট্যের কারণে সেই চেষ্টা মাঠে মারা গেছে। এবার আক্ষেপটা আরও বেশি কারণ ছবিতে অভিনয় করছেন রাজনীতির মতো তারকা। বিজয়কে নিয়ে লোকেশের আগের ছবিগুলোতে মনে হতো, ছবি পুরোপুরি বিজয়েরও নয়, আবার পুরোপুরি লোকেশেরও নয়; কিন্তু ‘কুলি’তে হলো উল্টো—এ যেন একই সঙ্গে আরেকটি রজনীকান্ত ছবি বানানোর চেষ্টা, আবার আরেকটি লোকেশ ছবিও বানানোর মরিয়া প্রয়াস।
‘কুলি’তে রজনীকান্ত। আইএমডিবি এটা করতে গিয়ে তিনি মনে করিয়েছেন ১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া রজনীর সিনেমা বাশার স্মৃতি। এ ছবিতেও রজনীর আসল চরিত্র কোথা থেকে এসেছে, সেটি আন্দাজ করার খেলাই যেন মূল আকর্ষণ। রজনীকান্ত আলোচিত তাঁর স্টাইলিস্ট অ্যাকশনের জন্য, ‘জেলার’ সিনেমায় তা দারুণভাবে করতে পেরেছিলেন নির্মাতা। কিন্তু আশ্চর্যভাবে কুলিতে অ্যাকশনের চেয়ে যেন রজনীর মজার দৃশ্যগুলোই জমেছে বেশি।
লোকেশ এবার ক্লান্তিকর প্লটকে বাঁচাতে এতগুলো টুইস্ট, সাবপ্লট আর চরিত্র যোগ করেছেন যে শেষে মনে হয় জটিল জালে আটকে ফেলেছেন তিনি। গল্পের কেন্দ্র থেকে সরে গিয়ে যেন প্রতি ২০ মিনিটে একটি বড় ‘শক’ দেওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে। এই স্টাইল অ্যাটলির; লোকশও কি তাঁকে অনুসরণ করা শুরু করলেন নাকি?
টুইস্টের পর টুইস্ট দ্রুতই ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। যেমন এতিম দেবাকে পরিবারকেন্দ্রিক আবেগে ঠেলে দেওয়া বা শৈশবের বন্ধুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের গভীরতা দেখানো—সবই অসংলগ্ন। শ্রুতি হাসানের প্রীতি চরিত্রটা বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেবার ওপর এত রাগ করল কেন, সেটি তো আসলে দর্শককে জানানোই হলো না।
‘কুলি’তে রজনীকান্ত। এক্স থেকে লোকেশ আসলে এই সিনেমায় কমল হাসানকে নিয়ে নির্মিত তাঁর আগের সিনেমা ‘বিক্রম’-এর কাঠামোই আরেকবার ব্যবহার করতে চেয়েছেন। যেমন কামাল হাসানের ব্ল্যাক অপস স্কোয়াড, তেমনি এখানে দেখা যায়, দেবারও এক হিংস্র অতীতের বাহক কুলিদের দলের অংশ। এ ছবিটির সঙ্গে ‘বিক্রম’-এর ছন্দের সঙ্গে মিল এত বেশি যে, নতুন কিছু করার বদলে কেবল সুপারস্টারকে ঘিরেই আবর্তিত হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। তবে রজনীকান্ত নামটাই যেখানে যথেষ্ট সেখানে হয়তো ভক্তদের এসব খামতি চোখে পড়বে না। ৭৪ বছর বয়সেও রজনীকান্ত পর্দায় রাজত্ব করেন। এক ভ্রুকুটি, এক হাসি কিংবা সিগারেট ঘোরানোর স্টাইল—প্রতিটি মুহূর্তই ভক্তদের নাড়িয়ে দিতে বাধ্য। তবে সবচেয়ে হতাশ করেছেন আমির খান। ছবির একেবারে শেষে অদ্ভুত লুকে কেন তাঁকে হাজির করা হলো কিছুই বোঝা গেল না।
গিরিশ গঙ্গাধরনের ক্যামেরা ছবিকে একধরনের তীব্রতা দেয়। রজনী যেন সময়কেও হারিয়ে দেন—গল্প যত জটিল হয়, তাঁর ভ্রুকুটি, স্ন্যাপিং দৃষ্টি আর ঠোঁটের কোণে হাসি দিয়ে সবকিছুকেই বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন। গানের দৃশ্য, ‘ব্রেকিং ব্যাড’-এর সংলাপমিশ্রিত ডান্স ট্র্যাক ছবিতে কিছু প্রাণসঞ্চার করে।
‘কুলি’তে রজনীকান্ত। এক্স থেকে ছবির সত্যিকারের নায়ক অবশ্য অনিরুদ্ধ। ‘বিক্রম’, ‘জেলার’, ‘লিও’—সবখানেই প্রমাণ দিয়েছেন। ‘কুলি’তে তিনি হয়তো আলাদা কোনো ‘হিট থিম’ দেননি; কিন্তু তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছবির নীরস মুহূর্তগুলোতেও প্রাণ জুগিয়েছে। তবে সিনেমা হিসেবে কুলি জুতসই হয়নি, রজনী আর লোকেশের যুগলবন্দী নিয়ে প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল!
সূত্র: প্রথম আলো