তেজগাঁওয়ে জমজমাট মধুমেলা: লিচু, কালিজিরা, শিলাজিৎসহ হরেক রকম মধুর পসরা

শুধু খাদ্য ও ওষুধ হিসেবে নয়; বেশ কয়েক বছরে বাণিজ্যিকভাবেও মধুর উৎপাদন হচ্ছে। তাই মধুর বৈচিত্র্য, মৌ চাষ উন্নয়ন ও মধুর উপকারিতা তুলে ধরতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এই মেলার আয়োজন করা হয়। পাঁচ দিনব্যাপী ‘মধুমেলা’র আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
মেলায় সব মিলিয়ে ৭ থেকে ১০ ধরনের মধুর পসরা সাজিয়ে বসেছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা উদ্যোক্তারা। এদের বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই অনলাইনে মধুর পাশাপাশি নানা ধরনের পণ্য বিক্রি করছেন। মেলায় মধুর সঙ্গে নানা ধরনের বাদাম, নাড়ু, হাতে তৈরি আখের চিনি, নারকেল ভাজা, সরিষার তেল, শজনে পাতার গুঁড়াসহ নানান ধরনের মুখরোচক খাবার পণ্য বিক্রি হচ্ছে। মেলায় অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ উদ্যোক্তা বলছেন, এই সময়ে লিচু ফুলের মধুর আধিক্য থাকে। তাই চাহিদা ও বিক্রি বেশি লিচু ফুলের মধুর।
এ ছাড়া মেলায় খলিশা ফুলের মধু, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক মধু, শিলাজিৎ মধু, মিশ্র ফুলের মধু, কালিজিরা ফুলের মধু, লিচু ফুলের মধু, সরিষা ফুলের মধুও পাওয়া যাচ্ছে। এসব মধু কেজিপ্রতি মান ও প্রকারভেদে মিলছে ৭০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া বিভিন্ন মসলার নির্যাস দিয়ে তৈরি মধুও পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। মেলা চলবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।
কী কী ধরনের মধু পাওয়া যাচ্ছে
মেলায় অন্যতম আকর্ষণ ছিল মধু বিক্রির প্রতিষ্ঠান ন্যাচারোর শিলাজিৎ মধু। পার্বত্য অঞ্চলের খনিজজাত উপাদান শিলাজিৎ ও মধুর মিশ্রণে তৈরি হয় এই বিশেষ ধরনের মধু। শিলাজিৎ শরীরের শক্তি ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক বলে জানান উৎপাদকেরা।
ন্যাচারোর গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, আমরা বিভিন্ন ভেষজ নির্যাস দিয়ে মধু তৈরি করি। এর ফলে মধুর পুষ্টিগুণ বাড়ানো যায়। এর মধ্যে আমাদের শিলাজিৎ মধু বেশ পরিচিত। শিলাজিৎ খালি খেতে বেশ তেতো ধরনের। তাই মধুর মাধ্যমে শিলাজিৎ খাওয়া আরও সহজ হয়ে ওঠে।
মেলায় লিচু ফুল থেকে আহৃত লিচু মধুর রং হালকা সোনালি হয়। এর সঙ্গে লিচু মধুতে লিচুর সুগন্ধ রয়েছে। দেশের নেত্রকোনা, জামালপুর ও ময়মনসিংহসহ নানা অঞ্চলের লিচুর বাগান থেকে এই মধু সংগ্রহ করা হয়।
এ ছাড়া মেলায় কালিজিরা ফুল থেকে মধুরস সংগৃহীত কালিজিরা মধুও পাওয়া যাচ্ছে। দেশে সীমিত আকারে রাজশাহী, নাটোর, যশোর ও দিনাজপুর অঞ্চলে বেশি কালিজিরার মধুর চাষ হয়। মেলায় ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন পরিমাণের কালিজিরার মধু বিক্রি হচ্ছে। আর শিলাজিৎ মধু পাওয়া যাচ্ছে কেজিপ্রতি ৮২০ টাকায়। এ ছাড়া বিভিন্ন পরিমাণের সাধারণ মধু পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার টাকার মধ্যে।
সুন্দরবনের খলিশাগাছের ফুল থেকে সংগ্রহকৃত খলিশা মধু কিছুটা দুর্লভ। খলিশা ফুলের নির্যাসে তৈরি মধুর প্রাকৃতিক ঔষধি গুণাবলির জন্য বেশি পরিচিত।
ভিড় বেশি মৌবাজার ও ইনস্টা পিওরের স্টলে
মেলায় অন্যতম আকর্ষণ ছিল মৌবাজার নামে একটি স্টল ঘিরে। তিনটি অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) মিলে মোট ৫০ জন মৌচাষিকে নিয়ে বগুড়ায় মধুর হাট গড়ে উঠেছে। এই মধুর হাট পরিচালনা করে নর্থ বেঙ্গল হানি কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড। এবারের মেলায় এই কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ মোট ৪ জেলার মধু নিয়ে অংশগ্রহণ করেছে।
নর্থ বেঙ্গল হানি কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মেলায় আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ টাকার মধু বিক্রি করেছি। এ ছাড়া ৮ টন মধুর ক্রয়াদেশ নিয়ে এক ক্রেতার সঙ্গে কথা চলছে। এর মধ্যে এক টন সরিষা ফুলের মধু, আর বাকি ৭ টন লিচু ফলের মধু।
মধুর এই কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ তৈরির পেছনে কাজ করেছে শিক্ষা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম নামে একটি অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির শাকিউল মিল্লাত বলেন, আমাদের আরেকটা বড় লক্ষ্য হচ্ছে পরিবেশবান্ধব কৃষি বা অ্যাগ্রো ইকোলজি। আমরা ছোট ছোট মৌচাষিকে একত্রিত করে একটি কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি। তবে মধুকে রপ্তানিযোগ্য পণ্য করতে চাষের অবকাঠামো ও প্রচারে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
মেলায় এফএম প্লাস্টিকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে ইনস্টা পিওরের স্টলে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখা যায়। এবারের মেলায় প্রতিষ্ঠানটি মধুর চামচ ও মধুর স্যাশে (ছোট বা স্টিক প্যাক) এনেছে। মেলা উপলক্ষে ১০ গ্রামের মধুর চামচ পাওয়া যাচ্ছে ২৫ টাকায়। মূলত চা, পাউরুটি কিংবা অন্য খাবারের সঙ্গে খাওয়ার জন্য এ ধরনের প্যাকেজিংয়ে এই খাবার তৈরি করা হয়।
এফএম প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী তৌহিদুর রহমান বলেন, বোতল থেকে মধু খাওয়া অনেক সময় স্বাস্থ্যকর নয়। একজন মানুষ দিনে ১০ গ্রাম পরিমাণ মধু খেলে যথেষ্ট। এ জন্য আমরা এ ধরনের প্যাকেট মধু নিয়ে এসেছি। অফিস বা কাজে যাওয়ার সময় সহজে কেউ পকেটে ভরে নিয়ে খেতে পারবে। কেউ চাইলে আমরা তাঁদের ব্র্যান্ড অনুযায়ী প্যাকেজিং তৈরি করে দেওয়া সেবাও দিচ্ছি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে লিচু ও সরিষা ফুলের মধু বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু সারা বছর উৎপাদন বাড়াতে হলে বিভিন্ন মৌসুমে ফুল ফোটে এমন গাছ লাগাতে হবে। বিদেশি মধুর তুলনায় দেশি মধুই খারাপ এই ধারণা ভাঙতে হবে। মৌমাছির বিষ (বি ভেনম) ও জেলি সংগ্রহ করলে বিপুল অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি হতে পারে। বর্তমানে দেশে আনুমানিক এক হাজার কোটি টাকার মধুর বাজার রয়েছে।
মধুমেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মৌচাষিদের ৩০টি স্টল রয়েছে। পাঁচ দিনব্যাপী এ মেলা চলবে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য মেলা উন্মুক্ত থাকবে।
সূত্র: প্রথম আলো