শুক্রবার   ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ || ১০ আশ্বিন ১৪৩২

জাগ্রত জয়পুরহাট

প্রকাশিত : ১৩:৫৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আবারও ঢাকামুখী ডেঙ্গু, ঝুঁকিতে তরুণ-তরুণীরা

আবারও ঢাকামুখী ডেঙ্গু, ঝুঁকিতে তরুণ-তরুণীরা
সংগৃহীত

দিন দশেক আগে শরীরে জ্বর অনুভব করেন মাসুদুর রহমান। সঙ্গে তীব্র ব্যথাও। সাধারণ ওষুধে সেরে না ওঠায় শরণাপন্ন হন চিকিৎসকের। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শনাক্ত হয় ডেঙ্গু। কমতে থাকে রক্তের প্লাটিলেটও। এরপরই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেন স্বজনেরা। ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন রাজধানীর দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসার এ শিক্ষার্থী।

মাসুদের মতোই মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি আছেন গাজীপুরের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী মো. আনোয়ার। জ্বরের সঙ্গে অনবরত বমি হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে তার। গত চার দিন চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থতার পথে তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২১ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে চলতি বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। এদিন মারা যান ১২ জন। এর মধ্যে পাঁচজনই মারা গেছেন বরিশাল বিভাগে। এ নিয়ে এডিস মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১৭৯ জনে। মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৪১ হাজার ৮৩১ জন।

গত জুলাইয়ে ডেঙ্গুর হটস্পট ছিল বরিশাল বিভাগ। কিন্তু মাস ঘুরতেই ফের রাজধানীতে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। ১৭ সেপ্টেম্বরের তথ্যানুযায়ী ডেঙ্গুতে মৃত পাঁচজনের দুজনই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দা। ওইদিন আক্রান্ত হয়েছেন ৬২২ জন। এর মধ্যে রাজধানীতেই শনাক্তের সংখ্যা ১৯৯। এর দুদিন আগেও শনাক্তের দিক থেকে শীর্ষে ছিল রাজধানী
শনাক্ত ও মৃতের দিক থেকে পুরুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ ৬০.৩ শতাংশ পুরুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতে। নারী রয়েছেন ৩৯.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ঝুঁকিতে ২১-২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা। মশাবাহিত এ রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও প্রাণ হারাচ্ছেন এমন বয়সীরা

বিভাগভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, এই ১২ জনের মধ্যে বরিশাল বিভাগে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়। বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন জন ও দুজন বরগুনায় মারা গেছেন। বাকি সাতজনের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির হাসপাতালগুলোতে তিনজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় দুজন এবং চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে একজন করে মারা গেছেন। সর্বশেষ মৃত্যুর তালিকায় শিশু থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত জুলাইয়ে ডেঙ্গুর হটস্পট ছিল বরিশাল বিভাগ। কিন্তু মাস ঘুরতেই ফের রাজধানীতে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। ১৭ সেপ্টেম্বরের তথ্যানুযায়ী ডেঙ্গুতে মৃত পাঁচজনের দুজনই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দা। ওইদিন আক্রান্ত হয়েছেন ৬২২ জন। এর মধ্যে রাজধানীতেই শনাক্তের সংখ্যা ১৯৯। এর দুদিন আগেও শনাক্তের দিক থেকে শীর্ষে ছিল রাজধানী। ১৪ সেপ্টেম্বর ৬৮৫ জনের মধ্যে ঢাকায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ২৪৪ জন।

তথ্য বলছে, শনাক্ত ও মৃতের দিক থেকে পুরুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ ৬০.৩ শতাংশ পুরুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতে। নারী রয়েছেন ৩৯.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ঝুঁকিতে ২১-২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীরা। মশাবাহিত এ রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও প্রাণ হারাচ্ছেন এমন বয়সীরা।

আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতি বছরই এ সময়টায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কারণ, বর্ষায় এডিসের লার্ভার ঘনত্ব কয়েকগুণ বেশি বেড়ে যায়। এছাড়া, ডেঙ্গুর ঢাকামুখী হওয়ার অন্যতম কারণ হলো বাইরের রোগী। অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীতে চিকিৎসা নিতে চলে আসেন তারাঅধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার, বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, নিপসম

গত শনিবার পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন ৫৬ জন। এর মধ্যে ডেডিকেটেড (পুরুষ) ইউনিটে ২৮ ও নারী ইউনিটে ১৯ জন ছিলেন। অন্য ইউনিটে ছিলেন নয়জন। এমনটাই জানিয়েছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স জিয়াসমিন আখতার।

পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় রাজধানীর মাতুয়াইল থেকে আসা মাসুদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, শুরুতে জ্বরের সঙ্গে শরীরে তীব্র ব্যথা ছিল। স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ খান। তবে, কোনো কাজ না হওয়ায় মাতুয়াইলে কেয়ার ডি-ল্যাব অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারে যান। পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে ১৩ সেপ্টেম্বর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবার। বর্তমানে অনেকটা সুস্থ রয়েছেন বলে জানান তিনি।

মশাবাহিত এ রোগ মোকাবিলায় শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। স্বরাষ্ট্র, আইন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কেও সমানতালে কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবেঅধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার, বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, নিপসম

একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন জাকির হোসেনের স্ত্রী আনজুম আরা বলেন, ‘আমাদের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। গত কয়েক দিন আমার স্বামীর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছিল। এ অবস্থায় তাকে স্থানীয় আনোয়ার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। ১৯ সেপ্টেম্বর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা এখনও অপরিবর্তিত।’

এদিকে, আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতি বছরই এ সময়টায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে বাংলাদেশে। কারণ, বর্ষায় এডিসের লার্ভার ঘনত্ব কয়েকগুণ বেশি বেড়ে যায়। এছাড়া, ডেঙ্গুর ঢাকামুখী হওয়ার অন্যতম কারণ হলো বাইরের রোগী। অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীতে চিকিৎসা নিতে চলে আসেন তারা।’

ড. ছারোয়ার বলেন, ‘রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি হাসপাতালে বিশেষ ইউনিট রয়েছে। আর এসব জায়গায় প্রতিনিয়ত চিকিৎসা নিতে আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের রোগীরা। ফলে রোগীর আলাদা বা বিশেষ যত্ন না নিলে পূর্ণাঙ্গ মশা একজন সুস্থ মানুষকেও কামড়ায়। পরবর্তীতে ওই মানুষটাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এজন্য হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের অধিক যত্নের সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়। তবে, বাইরের আক্রান্তরা এভাবে আসতে থাকলে ঢাকায় খুব দ্রুতই রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।’

কোনো এলাকায় যখন ডেঙ্গু বাড়তে বাড়তে পিক বা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়, তখন ধীরে ধীরে আবার কমতে থাকে। ঢাকায় এখনও তেমন না হওয়ায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। আগামী মাসে এটি আরও বাড়তে পারেঅধ্যাপক কবিরুল বাশার, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত চেষ্টা থাকা প্রয়োজন— জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘মশাবাহিত এ রোগ মোকাবিলায় শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। স্বরাষ্ট্র, আইন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কেও সমানতালে কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। বাসাবাড়ি, ছাদ, নির্মাণাধীন ভবনে জমাটবদ্ধ পানি নিষ্কাশনে সিটি কর্পোরেশনের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের পরিষ্কার করতে হবে। কেননা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে এডিস মশা। এসির পানিতে, ডাবের খোসায় থাকা অল্প পানিতেও ডেঙ্গু মশা জন্ম নেয়। তাই আরেকটু সচেতন হলে মশার বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এ মহামারি থেকে বাঁচা সম্ভব।’

ডেঙ্গু ফের ঢাকামুখী হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কোনো এলাকায় যখন ডেঙ্গু বাড়তে বাড়তে পিক বা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়, তখন ধীরে ধীরে আবার কমতে থাকে। ঢাকায় এখনও তেমন না হওয়ায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। আগামী মাসে এটি আরও বাড়তে পারে।’

‘এডিস মশার ঘনত্বের সঙ্গে ডেঙ্গুর সম্পর্ক রয়েছে। তবে, ডেঙ্গু বাড়ার পেছনে শুধুমাত্র এডিসের লার্ভার ঘনত্বই দায়ী নয়। পূর্ণাঙ্গ মশার ঘনত্ব ও জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রভাবও আছে। এর প্রভাবে পৃথিবীর অনেক দেশেই এডিস মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। এছাড়া, জলাবদ্ধতার সঙ্গে ডেঙ্গুর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তবে, জলাবদ্ধতা নিরসন করা প্রয়োজন। কারণ, এর সঙ্গে কিউলেক্স মশার ঘনত্বের একটি সম্পর্ক রয়েছে। জলাবদ্ধ স্থানে এ ধরনের মশা সবচেয়ে বেশি জন্মায়।’ তাই মশা উৎপাদনের জায়গাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এই কীটতত্ত্ববিদ।

সূত্র: ঢাকা পোষ্ট

সর্বশেষ

শিরোনাম