সোমবার   ১৪ অক্টোবর ২০২৪ || ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

প্রকাশিত : ১৭:৪৮, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

পর্ব- ১

জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বাংলাদেশের যেসব পণ্য

জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বাংলাদেশের যেসব পণ্য
সংগৃহীত

বাংলাদেশের মোট ২১টি পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে এখন পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছে। এছাড়া মোট ১৪টি পণ্যের জিআই স্বীকৃতির জন্য নতুন করে আবেদন জমা পড়েছে। মূলত বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

কোনো একটি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কোন পণ্য জি-আই স্বীকৃতি পেলে পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়, বাড়ে কদর। এর ফলে দেশে পর্যটন বাড়ে, রফতানি বাড়ে, কৃষক, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়।

বাংলাদেশে অনেক কিছুই রয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এমন অনেক পণ্য রয়েছে, মান ঠিক রেখে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও উৎপাদন করা সম্ভব নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক বিশেষ পণ্য রয়েছে যেগুলোর এখনো স্বীকৃতি পাওয়া হয়ে ওঠেনি। এমন পণ্য নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব আজ-

জামালপুরের নকশিকাঁথা

জামালপুর জেলাকে অনেকেই বলে থাকে ‘হস্তশিল্পের শহর’। ২০১৭ সালে নকশিকাঁথাকে জামালপুর জেলার ব্র্যান্ড নির্বাচন করা হয়। এখানকার নকশিকাঁথা ও হাতের কাজের বাহারী পোশাক পরিচ্ছদ সারাদেশে বহু আগে থেকেই প্রশংসিত হচ্ছে।

জামালপুরের অনেক নারীর টিকে থাকার হাতিয়ার প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য নকশি কাঁথা ও হস্তশিল্প৷ এখানকার নারীরা নিপুণ হাতে নকশিকাঁথার যে নকশাগুলো অঙ্কন করেন, তার ইতিহাস সুপ্রাচীন। যুগে যুগে মায়াবী হাতের সুনিপুণতায় চিত্রিত করছেন মা, মাটি, মানুষ আর ভালোবাসার প্রতিকৃতি।

জামালপুরের নকশিকাঁথা, তথা সূচিশিল্পের বিভিন্ন বাহারি পণ্য ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জামালপুরের এই পণ্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

যশোরের খেজুর গুড়

প্রাচীনকাল থেকে অবিভক্ত ভারতে খেজুর গুড়ের জন্য যশোর জেলা বিখ্যাত ছিল। এজন্য একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস।’

ইতিহাস বলছে, ১৮৬১ সালে যশোরের চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউস কারখানা স্থাপন করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্রাউন সুগার উৎপাদন শুরু করেন। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস বইতে পাওয়া যায়, ১৯০০-০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মণ, যা প্রায় ৮২ হাজার টনের সমান।

দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেলেও বদলায়নি যশোরের গুড় ও পাটালি তৈরির রেওয়াজ। এই ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছে যশোরের বৃহত্তর খাজুরা অঞ্চলের গাছিরা।

সুন্দরবনের মধু

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন মধুর স্বর্গরাজ্য। সুন্দরবনের মধুর উৎস বাদাবনের নানান লবণাম্বু গাছের ফুল, যেমন, খলিশা, বাইন, তোরা, গরাণ, কেওড়া, ইত্যাদি। বসন্তকাল থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত এইসব গাছে প্রচুর ফুল ফোটে। তাই সুন্দরবনে মধুর মৌসুম মূলত মার্চ-এপ্রিল-মে মাস।

সুন্দরবনের জঙ্গলে যেসব লবণাম্বু গাছের ফুল ফোটে তাদের প্রত্যেকটির পুষ্পরস ও পরাগের স্বাদগন্ধ স্বতন্ত্র। সুন্দরবনের পাঁচমিশালি ফুলের মধুর স্বাদ ও ফ্লেভার এই সব ভিন্ন ভিন্ন ফুলের মধুর স্বাদগন্ধের যোগফল।

সুন্দরবনের মধু ঘিরে গড়ে উঠেছে বুড়িগোয়ালিনী, নীল ডুমুর, গাবুরা এলাকায় মধুর মোকাম। যেখান থেকে মধু ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে।

মুক্তাগাছার মন্ডা

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার নাম নিলেই চলে আসে মণ্ডার নাম। এখানকার মণ্ডার সুখ্যাতি শোনেননি, এমন মানুষ বোধ হয় কম পাওয়া যাবে।

মুক্তাগাছার মণ্ডার আবিষ্কারক গোপাল পাল। ময়মনসিংহ সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমের মুক্তাগাছায় ‘গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানের’ অবস্থান। তিনি ১৮২৪ সালে দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর কেটে গেছে প্রায় ২০০ বছর। মণ্ডা তৈরির ব্যবসা চলছে বংশানুক্রমে। এখন পঞ্চম পুরুষের ব্যবসা চলছে।

মণ্ডা মূলত এক প্রকারের সন্দেশ। শুধু ছানা ও চিনি দিয়ে এটি বানানো হয়। তবে স্বাদের রহস্যটা লুকিয়ে আছে ‘প্রক্রিয়ার’ মধ্যে, যা বছরের পর বছর ধরে গোপন রেখেছেন গোপাল পালের বংশধরেরা।

রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম

হাঁড়িভাঙ্গা পরিণত হয়েছে রংপুরের ‘ব্র্যান্ডে’। দেশ ছাড়িয়ে এর সুনাম এখন বিশ্বে বিভিন্ন দেশে। বিশ্ববিখ্যাত এ হাড়িভাঙ্গা আমের উৎপত্তি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়ন থেকে।

১৯৪৯ সালে হাড়িভাঙ্গার গোঁড়া পত্তনকারী নফল উদ্দিনের লাগানো সেই মাতৃগাছটি আজও রংপুরের মিঠাপুকুরের খোড়াগাছের তেকানি গ্রামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন সেই গাছটির বয়স প্রায় ৭৫ বছর। এই গাছ থেকেই হাজার হাজার কলম তৈরি করে হাড়িভাঙ্গার চারা গাছ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

হাড়িভাঙ্গা আমের স্বাদ ও গন্ধ অন্যান্য আমের তুলনায় ভিন্ন। আঁশহীন এই আমের উপরের অংশ বেশ মোটা ও চওড়া এবং নিচের অংশ চিকন। হাড়িভাঙ্গা পাকলেও কিছুটা সবুজ থাকে এবং হালকা হলুদাভাব রূপ ধারণ করে। এক একটি আমের ওজন ৪০০-৭০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।

মৌলভীবাজারের আগর-আতর

মৌলভীবাজারের জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজানগরকে বলা হয় আগরের রাজধানী। এ খ্যাতি সেই মোঘল আমল থেকে। এখান থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার আগর-আতর রপ্তানি করা হয় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস এখানকার আগর-আতরের। ৬৫২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘হর্ষ চরিত’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, এ গ্রন্থের রচয়িতা আসামের মহারাজা বর্মণের কাছ থেকে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থেকে সংগৃহীত আগর কাঠ ও তরল আতর উপহার পেয়েছিলেন।

২০১৫ সালে শিল্প হিসেবে ঘোষণার পর বাণিজ্যিকভাবে আগরের চাষ বেড়েছে এ অঞ্চলে। আগর-আতর শিল্পের সঙ্গে মৌলভীবাজারের ৪০-৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে।

 

ঢাকার বাকরখানি। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার বাকরখানি। ছবি: সংগৃহীত

 

ঢাকার বাকরখানি

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ বাকরখানি। বিভিন্ন দোকানের সামনে কাঁচের বাক্সে রাখা গোল গোল বাকরখানি ছাড়া পুরান ঢাকার মানুষের নাশতা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

মুঘল আমল থেকেই এই খাবারের প্রচলন শুরু হয় পুরান ঢাকায়। হেকিম হাবিবুর রহমান তার ‘ঢাকা পাচাস বারাস পেহলে’তে উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকা ছাড়া সমগ্র হিন্দুস্তানের কোথাও হিন্দু রুটিওয়ালারা বাকরখানি তৈরি করে না। ঢাকা শহরে এটি এত বিখ্যাত যে, সমগ্র বাংলায় এখান থেকে তা সওগাত হিসেবে প্রেরণ করা হয়।’

বাকরখানির মূলত দুটি প্রকরণ বেশি চোখে পড়ে। একটি নোনতা, অপরটি মিষ্টি। এ ছাড়াও রয়েছে পনির, কালোজিরা ও কিমার বাকরখানি।

ফেনীর খন্ডলের মিষ্টি

ফেনীর নিভৃত এক পল্লিতে উৎপত্তি হওয়া ‘খন্ডলের মিষ্টির’ সুনাম ছড়িয়ে গেছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। বাদ যায়নি আফ্রিকাও।

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে পরশুরামের খন্ডল হাই বাজারের নামেই নামকরণ হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির। খন্ডলের মিষ্টি প্রথম তৈরি করেছিলেন যোগল চন্দ্র দাস। এটি মূলত গরুর দুধের ছানা থেকে তৈরি খন্ডলের মিষ্টি এক ধরনের রসগোল্লা। খাঁটি দুধ থেকে ছানা তৈরি হয় বলে এ মিষ্টি এখনো সুস্বাদু।

মহিষের দই

নোয়াখালী, ভোলা ও ফেনীর ‘সিগনেচার’ খাবারের মধ্যে অন্যতম মহিষের দধি। অনেক স্থানে মহিষের দুধের দই তৈরি হলেও সবচেয়ে খ্যাতি পেয়েছে ভোলা, সুবর্ণচর ও হাতিয়ার দই।

প্রায় ২০০ বছর আগে উপার্জনের জন্য ভোলা ও নোয়াখালীর মানুষ তারা মহিষ পালন শুরু করে। তখনই মহিষের কাঁচা দুধ থেকে দই তৈরির প্রচলন শুরু হয়। তবে ষাটের দশকে অনেক পরিবারই বাণিজ্যিকভাবে মহিষের দই তৈরি করা শুরু করে।

মহিষের দধি ফেনী, নোয়াখালী, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। উৎপাদিত মহিষের দধি খুবই সুস্বাদু বিদায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন চাপরাশিরহাট বাজারে দধি নেয়ার জন্য ভিড় জমায়।

নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা

বাংলাদেশের মধ্যে সুস্বাদু কলার জন্য বিখ্যাত নরসিংদী জেলা; বিশেষ করে অমৃতসাগর কলা। এই কলা ছিল ঢাকার নবাবদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পছন্দের ফল।

ইতিহাসবিদদের মতে, ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষাবাদ হতো। পাকিস্তান শাসনামলে ‘কলার গাড়ি’ নামক বাংলাদেশের রেলওয়ের একটি লোকাল ট্রেনের নামকরণ করা হয়েছিল শুধুমাত্র নরসিংদী জেলার কলা রফতানির জন্য।

নরসিংদীর অমৃতসাগর কলার সুখ্যাতির অন্যতম কারণ হল গন্ধ ও স্বাদ; দেখতেও অপূর্ব যেমন আকার তেমন রং। নরসিংদীর অর্জুনচর বাজারে শুধুই কলা বিক্রি করা হয়।

 

সূত্র: ডেইলি-বাংলাদেশ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ