সোমবার   ১৩ অক্টোবর ২০২৫ || ২৭ আশ্বিন ১৪৩২

জাগ্রত জয়পুরহাট

প্রকাশিত : ১৮:৫৯, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

নকশিকাঁথা তৈরি করে স্বাবলম্বী জয়পুরহাটের শতশত নারী

নকশিকাঁথা তৈরি করে স্বাবলম্বী জয়পুরহাটের শতশত নারী
সংগৃহীত

জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে ক্ষেতলালে, নকশিকাঁথা তৈরি হচ্ছে এবং এটি একটি ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প হিসেবে পরিচিত। আলমপুর ও এর আশপাশের ১০ গ্রামে শতশত নারী নকশিকাঁথা সেলাই করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

জেলার ক্ষেতলাল উপজেলা নকশিকাঁথা তৈরির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানকার নারীরা হস্তশিল্পের মাধ্যমে নকশিকাঁথা তৈরি করেন, যা শুধু দেশেই নয়, এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

বিভিন্ন সমিতির মাধ্যমে নারীদের নকশিকাঁথা সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তারা এই হস্তশিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

তৈরি হওয়া নকশিকাঁথাগুলো বর্তমানে কৃষিমেলা, হস্তশিল্প মেলা, বস্ত্রমেলাসহ বিভিন্ন মেলায় বিক্রি হয়। এছাড়াও, বগুড়া, জয়পুরহাট ও ঢাকার অনেক শোরুম মালিকরা এবং বিদেশে হস্তপণ্য রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এসব নকশিকাঁথা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়।

যদিও জয়পুরহাটের কালাইয়ে এই কুটির শিল্পটি হারিয়ে যাচ্ছে বলে একটি সংবাদে উল্লেখ আছে, তবে ক্ষেতলাল এলাকায় নকশিকাঁথা তৈরি ও বিপণন কার্যক্রম এখনও বেশ সক্রিয়।

ময়মনসিংহ গীতিকায় কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণকাব্যে সীতার গুণের কথা বলতে গিয়ে নকশিকাঁথার প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। সেখানে বলা হয়,‘সীতার গুণের কথা কী কহিব আর, কন্থায় আঁকিল কন্যা চান, সুরুয, পাহাড়’ সেই আদিকাল থেকেই নকশিকাঁথা বাঙালির ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের অন্যতম উপকরণে সাক্ষ্য বহন করে আসছে। গ্রামীণ জনপদ ছাড়িয়ে নকশিকাঁথার কদর এখন পা-রেখেছে বিদেশের মাটিতেও। জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর, দক্ষিণ বাঁশতা (বস্তা), বানাইচ, কানাইপুকুর, বানিয়াচাপড়, শিবপুরসহ আশপাশের প্রায় ১০ গ্রামের শতাধিক নারীদের নিপূণ হাতে তৈরি হচ্ছে বাহারি সব নকশিকাঁথা। ওই সব গ্রামের অনেক নারীরা নকশিকাঁথা তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন। তাদের তৈরি নকশিকাঁথা এখন বিদেশেও যাচ্ছে।

স্বদেশপ্রীতি নামে নারীদের একটি সংগঠন এই নারীদের সাথে যোগাযোগ ও নকশিকাঁথা বিপণনের ব্যবস্থা করছে। সংগঠনটির উদ্যোক্তা আলমপুর গ্রামের গৃহবধূ জোবেদা আক্তার। তিনি আলমপুর জাগরণী মহিলা সমবায় সমিতির সভাপতি। ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর গ্রামেই জোবেদা আক্তারের বাবার বাড়ি। অল্প বয়সে বিয়ে হয় তার। স্বামী শাহ সুলতান মাহমুদ বগুড়ার কোন এক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাবরক্ষক পদে চাকরি করেন।

উদ্যোক্তা জোবেদা আক্তার বলেন, ২০০১ সালের দিকে আলমপুর গ্রামের ৩০-৩৫ জন নারীকে নিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই কার্যক্রম শুরু করেন। গঠন করা হয় আলমপুর জাগরণী মহিলা সমবায় সমিতি। পরে সমিতি থেকে নারীদের হস্তশিল্প, ব্লক-বাটিকসহ সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নারীদের তৈরি করা ‘নকশিকাঁথা’ গ্রাম ঘুরে সংগ্রহ করে তা পাইকারি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি শুরু হয়। প্রথমে এসব পণ্য কৃষিমেলা, হস্তশিল্প মেলাসহ বিভিন্ন মেলার স্টলে বিক্রি করা হতো। ধীরে ধীরে এ নকশিকাঁথা তৈরির মহাকর্মযজ্ঞ আলমপুর গ্রামের গুলি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামে । এখন প্রতি মাসে তৈরি হয় শতাধিক নকশিকাঁথা। বগুড়া, জয়পুরহাট ও ঢাকার বিভিন্ন শোরুম মালিক ছাড়াও বিদেশে হস্তপণ্য রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসব ‘নকশিকাঁথা’ সংগ্রহ করে। একটি কাঁথা তৈরিতে সময় লাগে ১-৪ মাস পর্যন্ত। একটি নকশিকাঁথা বিক্রি করে ৪- ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।

আলমপুর গ্রামের ঘরে ঘরে নারীরা সুই-সুতা হাতে নকশিকাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বানাইচ গ্রামের নাদিয়া আকতার ৬টি কাঁথা নিয়ে জোবেদা আক্তারের মাধ্যমে বিক্রি করতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ৩ মাসে ৬টি নকশিকাঁথা সেলাই করেছেন। এর মধ্যে গোলাপের ফুলতোলা একটি ‘গোলাপকাঁথা’। এতে খরচ পড়েছে প্রায় ৪ হাজার টাকা। অন্যগুলো ‘গুজরাটি কাঁথা’, ‘পার্টি কাঁথা’ ও ‘বিস্কুটকাঁথা’। এসব কাঁথায় খরচ পড়েছে প্রায় ২ হাজার টাকা করে। পাইকারি পর্যায়ে একেকটি ‘গোলাপকাঁথা’ কাজভেদে বিক্রি হয় ৭- ৮ হাজার টাকা। অন্যগুলো বিক্রি হয় সাড়ে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা।

নকশিকাঁথা সেলাইয়ে বেশ অনেক রকমফের রয়েছে। রান ফোঁড়, ডবল রান ফোঁড়, ডারনিং ফোঁড়, বেঁকি ফোঁড়, বখেয়া ফোঁড়, বোতামঘর, চেইন ফোঁড়, পখুরি, তারা ফোঁড় ইত্যাদি ফোঁড় বা সেলাইয়ে নকশিকাঁথা বোনা হয়।

নারী কারিগরেরা জানান, নকশিকাঁথার নকশার ওপর নানা নাম দেওয়া হয়। আছে গোলাপকাঁথা, ময়ূরের পাখাকাঁথা, বলকাঁথা, গুজরাটি কাঁথা, প্রিন্ট কাঁথা, পুঁটি মাছের ঝাঁক কাঁথা, মৌমাছির চাক কাঁথা, সুজনী কাঁথা, পাটি কাঁথাসহ অনেক নাম।

নারীরা জানান, নকশিকাঁথা সেলাইয়ে রকমফের রয়েছে। রান ফোঁড়, ডবল রান ফোঁড়, ডারনিং ফোঁড়, বেঁকি ফোঁড়, বখেয়া ফোঁড়, বোতামঘর, চেইন ফোঁড়, পখুরি, তারা ফোঁড় ইত্যাদি ফোঁড় বা সেলাইয়ে নকশিকাঁথা বোনা হয়। নকশিকাঁথা সেলাইয়ে এসব ফোঁড়ই মূল।

নকশিকাঁথার এক অনন্যা কারিগর নাহিদা আকতার বলেন, হাট-বাজারের তাঁতিদের কাছ থেকে রঙিন কাপড় এবং লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলুদ প্রভৃতি রঙিন সুতা কিনে এনে নকশিকাঁথা সেলাই করেন তারা। কয়েকজন একসাথে বসে গল্পে গল্পে নকশিকাঁথার কাজ করেন। অনুপম দক্ষতায় কাঁথার জমিনে ফুটে ওঠে নিপূণ হাতের নৈপূর্ণ কারুকাজ। আবার কখনো কথনো কাঁথায় উঠে আসে দুঃখ-সুখের কাহিনিও।

অত্র অঞ্চলের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা মনে করেন, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প হিসেবে পরিচিত এই নকশিকাঁথার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং গ্রামীণ জনপদের এই অবহেলিত নারীদের সময়োপযোগী স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে হলে, গ্রামীণ খদে উদ্যোক্তাদের সরকারীভাবে যথাযথ পৃষ্টপোষকতা এখন সময়ের দাবি বলেও মনে করেন তারা।

সর্বশেষ

শিরোনাম