২ লাখ শিক্ষার্থীর ৪ লাখ খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল পুনঃনিরীক্ষণে এবার রেকর্ডসংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে মোট ২ লাখ ২৬ হাজার শিক্ষার্থী ৪ লাখ ২৮ হাজার খাতা পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছেন। ঢাকায় আবেদনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, আর বরিশাল বোর্ডে সবচেয়ে কম। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন বেশি করেছেন।
শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পুনঃনিরীক্ষণে ঢাকার পরেই রয়েছে কুমিল্লা ও রাজশাহী বোর্ড। বিপরীতে সবচেয়ে কম আবেদন পড়েছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে। গত ১৬ অক্টোবর ফল প্রকাশের পরদিন (১৭ অক্টোবর) থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৭ দিন শিক্ষার্থীরা প্রতি বিষয়ে ১৫০ টাকা ফি দিয়ে আবেদন করার সুযোগ পান।
ঢাকা বোর্ডের ২ লাখ ৯২ হাজার ৫৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছেন ৬৬ হাজার ১৫০ জন, যা থেকে জমা পড়েছে মোট ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০৬টি বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন।
কুমিল্লা বোর্ডে ৯৯ হাজার ৫৭৬ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২ হাজার ৫০৩ জন ৪২ হাজার ৪৪টি খাতা পুনঃনিরীক্ষণে আবেদন করেছেন। রাজশাহী বোর্ডে আবেদন করেছেন ২০ হাজার ৯২৪ জন শিক্ষার্থী, যেখান থেকে ৩৬ হাজার ১০২টি খাতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বোর্ডে ১ লাখ ১ হাজার ৮৪৯ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২ হাজার ৫৯৫ জনের আবেদন থেকে ৪৬ হাজার ১৪৮টি খাতা পুনঃনিরীক্ষণের তালিকায় এসেছে। যশোর বোর্ডে ২০ হাজার ৩৯৫ শিক্ষার্থী ৩৬ হাজার ২০৫টি বিষয়ে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছেন। দিনাজপুর বোর্ডে আবেদনকারীর সংখ্যা ১৭ হাজার ৩১৮ জন এবং খাতা ২৯ হাজার ২৯৭টি। ময়মনসিংহ বোর্ডে ১৫ হাজার ৫৯৮ জনের আবেদন থেকে খাতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৭৩৬টি।
কোনো খাতায় পুনরায় মূল্যায়ন বা নতুন করে নম্বর দেওয়া হয় না- শুধু গণনাগত বা ট্যাবুলেশনভিত্তিক ভুল পাওয়া গেলে তা সংশোধন করা হয়। ফল পুনঃনিরীক্ষণ শেষে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর কমানো হয় না, বরং যদি কোনো ভুল ধরা পড়ে, নম্বর শুধু বাড়ানো হয়। ফলে আবেদনকারীরা কোনো ঝুঁকিতে থাকেন না। সাধারণত পুনঃনিরীক্ষণের পর অনেক শিক্ষার্থীর ফলই পরিবর্তিত হয়ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের এক কর্মকর্তা
সিলেট বোর্ডে আবেদন করেছেন ১৩ হাজার ৪৪ জন শিক্ষার্থী এবং সেখানে ২৩ হাজার ৮২টি খাতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে (বিটিইবি) ১২ হাজার ৭ জন শিক্ষার্থীর আবেদনে ১৫ হাজার ৩৭৮টি খাতা পুনঃনিরীক্ষণের তালিকায় এসেছে।
মাদরাসা বোর্ডে আবেদন সংখ্যা ৭ হাজার ৯১৬ জন এবং খাতার সংখ্যা ১৪ হাজার ৭৩৩টি।
সবশেষে বরিশাল বোর্ডে আবেদনকারীর সংখ্যা সবচেয়ে কম- মাত্র ৮ হাজার ১১ জন শিক্ষার্থী। তাদের আবেদন থেকে ১৭ হাজার ৪৮৯টি খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আওতায় এসেছে।
ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে বেশি আবেদন
বোর্ড কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগের বছরগুলোর মতো এবারও ইংরেজি ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে সবচেয়ে বেশি পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন এসেছে।
কর্মকর্তাদের মতে, এই দুই বিষয়ে লেখনিভিত্তিক প্রশ্নসহ ধাপে ধাপে মার্কিং পদ্ধতির কারণে ভুল বা নম্বর অসঙ্গতির আশঙ্কা তুলনামূলক বেশি থাকে।
বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী ফল প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যেই পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করা হয়। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছেআন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশেষ করে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র এবং আইসিটি তত্ত্ব অংশে তাদের প্রাপ্ত নম্বর প্রত্যাশার তুলনায় কম এসেছে।
পুনঃনিরীক্ষণে কী করা হয়?
ফল পুনঃনিরীক্ষণে পরীক্ষার খাতা নতুন করে দেখা হয় না। বরং আবেদন পাওয়ার পর শিক্ষা বোর্ডের বিশেষ কমিটি বিশেষ কিছু ধাপ অনুসরণ করেন৷
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদনের ভিত্তিতে নম্বর যোগের ভুল সংশোধন করা হয়।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নভিত্তিক প্রাপ্ত নম্বর সঠিকভাবে যোগ হয়েছে কি না, তা যাচাই করা হয়। এরপর খাতার নম্বর ট্যাবুলেশন শিটে (ফল সংরক্ষণ তালিকা) সঠিকভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে কি না, সেটিও মিলিয়ে দেখা হয়। এছাড়া কোনো অতিরিক্ত উত্তরপত্র বা পৃষ্ঠা বাদ পড়ে গেছে কি না, সেটিও পরীক্ষা করা হয়। তবে নতুন করে মার্কিং করা হয় না।
তিনি আরও জানিয়েছেন, কোনো খাতায় পুনরায় মূল্যায়ন বা নতুন করে নম্বর দেওয়া হয় না- শুধু গণনাগত বা ট্যাবুলেশনভিত্তিক ভুল পাওয়া গেলে তা সংশোধন করা হয়। ফল পুনঃনিরীক্ষণ শেষে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর কমানো হয় না, বরং যদি কোনো ভুল ধরা পড়ে, নম্বর শুধু বাড়ানো হয়। ফলে আবেদনকারীরা কোনো ঝুঁকিতে থাকেন না। সাধারণত পুনঃনিরীক্ষণের পর অনেক শিক্ষার্থীর ফলই পরিবর্তিত হয়।
এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নে আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দেইনি, বা নির্দিষ্ট করে দেইনি যে এভাবে নম্বর ছাড় দেবেন বা ওভারমার্কিং করবেন। আর বেশি বেশি নম্বর দিয়ে পাসের হার বাড়াতে হবে- এ রকম কোনো নির্দেশনার প্রশ্নই ওঠে না। এইচএসসির ফলাফল খারাপ নয়, বরং এটি বাস্তবতার প্রতিফলন। আমরা ফল বানাইনি। বাস্তব চিত্রটাই এবার সামনে এসেছে। শিক্ষার্থীরা এখন টেবিল থেকে দূরে সরে গেছে। বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদেরও ভাবতে হবেআন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির
ফল প্রকাশের এক মাসের মধ্যেই পুনঃনিরীক্ষণের ফল
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহ্বায়ক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার জানিয়েছেন, বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী ফল প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যেই পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করা হয়। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা গত ১৬ অক্টোবর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছি। সে অনুযায়ী ১ মাসের মধ্যেই পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করা হবে।
তিনি জানান, ফল পরিবর্তন হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর মোবাইল নম্বরে এসএমএস পাঠানো হবে। পাশাপাশি সংশোধিত ফল সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ওয়েবসাইটেও দেখা যাবে।
এবার এইচএসসির ফলে ভরাডুবি
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় দেশের ৯ হাজার ১৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মোট ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে ৬ লাখ ১১ হাজার ৪৪৭ জন ছাত্র পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬৪ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩২ হাজার ৫৩ জন ছাত্র। ছাত্রদের পাসের হার ৫৪.৬০ শতাংশ। ছাত্রী অংশ নেন ৬ লাখ ২৪ হাজার ২১৫ জন। তাদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন ছাত্রী। ছাত্রীদের পাসের হার ৬২.৯৭ শতাংশ।
এটি কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং শিক্ষার বাস্তব চিত্র- যেখানে মুখস্থ নয়, বোঝাপড়ার সক্ষমতা যাচাই করা হচ্ছে। করোনার সময়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও নমনীয় মূল্যায়নের কারণে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন অভ্যাস দুর্বল হয়ে গেছে। এখন পূর্ণ সিলেবাসে ফিরে আসায় মৌলিক জ্ঞান ও বিশ্লেষণধর্মী দক্ষতার ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফিরে যাওয়া এবং বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার সময় এসেছেশিক্ষাবিদ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল অনুযায়ী, এবার মোট উত্তীর্ণ হয়েছেন ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন শিক্ষার্থী; যা মোট পরীক্ষার্থীর ৫৮.৮৩ শতাংশ। এছাড়া অকৃতকার্য হয়েছেন ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ জন শিক্ষার্থী, যা ৪১.১৭ শতাংশ।
বোর্ডের দায়িত্বশীল ও শিক্ষকরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা কমিয়েছেন, যার প্রভাব স্পষ্টভাবে পড়েছে পরীক্ষার খাতায়।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নে আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দেইনি, বা নির্দিষ্ট করে দেইনি যে এভাবে নম্বর ছাড় দেবেন বা ওভারমার্কিং করবেন। আর বেশি বেশি নম্বর দিয়ে পাসের হার বাড়াতে হবে- এ রকম কোনো নির্দেশনার প্রশ্নই ওঠে না। এইচএসসির ফলাফল খারাপ নয়, বরং এটি বাস্তবতার প্রতিফলন। আমরা ফল বানাইনি। বাস্তব চিত্রটাই এবার সামনে এসেছে। শিক্ষার্থীরা এখন টেবিল থেকে দূরে সরে গেছে। বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকদেরও ভাবতে হবে।
চেয়ারম্যান আরও জানান, ইংরেজি ও আইসিটিতে ফেলের সংখ্যা বেশি হয়েছে। ইংরেজিতে পাশের হার কমে এসেছে ৭৭ শতাংশ থেকে ৫৮ শতাংশে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তিনি বলেন, ইংরেজিতে এমসিকিউ বাদ থাকায় পরীক্ষা তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়েছে।
ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার মনে করেন, এইচএসসি ফলাফলকে হতাশার চোখে দেখা উচিত নয়।
তিনি বলেন, এটি কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং শিক্ষার বাস্তব চিত্র- যেখানে মুখস্থ নয়, বোঝাপড়ার সক্ষমতা যাচাই করা হচ্ছে। করোনার সময়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও নমনীয় মূল্যায়নের কারণে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন অভ্যাস দুর্বল হয়ে গেছে। এখন পূর্ণ সিলেবাসে ফিরে আসায় মৌলিক জ্ঞান ও বিশ্লেষণধর্মী দক্ষতার ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফিরে যাওয়া এবং বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার সময় এসেছে।
তিনি আরও বলেন, পরিচর্যা শুধু স্কুলে নয়, বাড়িতেও প্রয়োজন। শিক্ষকরা শুধু পাঠদান নয়, শেখার কৌশলও শেখাবেন এবং অভিভাবকরা নিশ্চিত হবেন সন্তান বোঝাপড়া করছে কি শুধু মুখস্থ করছে। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নে দুর্বল, তাই শিক্ষকদের এখানে বেশি কাজ করতে হবে।
সূত্র: ঢাকা পোষ্ট















